আগের বার মুখ খুলেছিলেন শুধু আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। এ বার দলের নেতৃত্বের আগাপাশতলা বদলের দাবিতে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকে সরব হলেন একাধিক প্রাক্তন মন্ত্রী ও প্রাক্তন সাংসদ। তাঁদের সম্মিলিত দাবি, মানুষের কাছে আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পেতে পুরনো মুখ বদলানোই আশু কর্তব্য। উঠে এল চিনের কমিউনিস্ট পার্টির উদাহরণ। যেখানে নেতাদের বয়সের সীমা বেঁধে দেওয়া আছে। রাজ্য কমিটিতে এমন প্রবল দাবির মুখেও রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু অবশ্য আপাত-নির্লিপ্ত! নেতৃত্ব বদল নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও আশ্বাস না দিয়ে শুক্রবার জবাবি ভাষণে তিনি জানিয়েছেন, শীঘ্রই আরও একটি রাজ্য কমিটির বৈঠক ডেকে নেতাদের সাংগঠনিক কাজের মূল্যায়ন হবে।
পরপর নির্বাচনে ভরাডুবির পরে সিপিএমের নেতৃত্বে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বামফ্রন্টের মধ্যে বিস্তর চর্চা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য কমিটির বৈঠকে এ ভাবে মুখ বদলের দাবি উঠে আসা সাম্প্রতিক কালে প্রথম। তবে জোরালো দাবির মুখেও রাজ্য নেতৃত্বের কাছ থেকে এ দিন বিবেচনার নির্দিষ্ট আশ্বাস না-পেয়ে হতাশ রাজ্য কমিটির বেশ কিছু সদস্য। এই পরিস্থিতিতেই আজ, শনিবার থেকে প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বর্ধিত অধিবেশন বসছে। সব জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও গণসংগঠনের নেতাদের নিয়ে ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকার কথা দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের। রাজ্য কমিটিতে এ দিন যে ভাবে পুরনো মুখ বদলে নতুনদের দায়িত্বে আনার কথা উঠেছে, কারাটের সামনে বর্ধিত অধিবেশনেও একই সুর বজায় থাকলে বিমানবাবুর উপরে চাপসৃষ্টি হবে বলে সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যা।
পঞ্চায়েত ভোটের পরে গত মাসে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির রিপোর্টেও পশ্চিমবঙ্গে সংগঠনকে নতুন করে সাজানোর কথা বলা হয়েছিল। তারই রূপরেখা তৈরি হওয়ার কথা রাজ্য কমিটির বর্ধিত অধিবেশনে। দু’দিনের ওই বৈঠকে পেশ করার জন্য যে খসড়া রিপোর্ট এ দিন রাজ্য কমিটিতে দেওয়া হয়েছিল, তাতে অবশ্য সরাসরি নেতৃত্বে রদবদলের ইঙ্গিত নেই। সেখানে নতুন কর্মী তুলে আনার উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। ওই খসড়ার উপরে রাজ্য কমিটি থেকে বেশ কিছু সংশোধনী অবশ্য জমা পড়েছে। যেখানে বলা হয়েছে নতুন মুখ আনতে গেলে পুরনো মুখ সরাতেও হবে। সংশোধনী বিবেচনা করে পরিমার্জিত রিপোর্ট আজ বৈঠকে পেশ করবেন রাজ্য সম্পাদক। নেতৃত্বের খোলনলচে বদলাতে চেয়ে আগের রাজ্য কমিটির বৈঠকে রেজ্জাক এবং শমীক লাহিড়ী যে নোট জমা দিয়েছিলেন, তারও কোনও উল্লেখ অবশ্য এ দিন হয়নি। শেষ পর্যন্ত লোকসভা ভোটের আগে রাজ্য তো পরের কথা, প্রশ্নের মুখে-পড়া কিছু জেলা সম্পাদক বদলের ঝুঁকিও তারা কতটা নিতে পারবে, সেটাই এখন আলিমুদ্দিনের সামনে চ্যালেঞ্জ।
রিপোর্টে না-থাকলেও বৈঠকের মধ্যে এ দিন খোলাখুলি দাবি তুলতে পিছপা হননি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যই। শুধু সন্ত্রাস বা ভোটের শতাংশের বিচার নয়। জনবিচ্ছিন্নতা কাটানোর রাস্তা খোঁজাই আসল কাজ বলে শুরু করেছিলেন শিলিগুড়ির এক নেতা। সেই সূত্র ধরেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক প্রাক্তন সাংসদ বলেন, গত ২৭ মাসে এমন কিছু কাজ দল করতে পারেনি, যাতে জনবিচ্ছিন্নতা কেটে যেতে পারে! রাজ্য জুড়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কিন্তু সারদা-কাণ্ড নিয়ে বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে দল ব্যর্থ। একেবারে উপর তলা থেকে নেতৃত্বে বদল শুরু না-হলে কোনও পরিবর্তন আসা কঠিন, বলেন তিনি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ, উত্তর ২৪ পরগনার এক প্রাক্তন মন্ত্রীও একই ভাবে মুখ পরিবর্তনের দাবিতে সরব হন। কলকাতার এক প্রাক্তন মন্ত্রী বলেন, কে কবে কাকে কী ভাবে সরাবে, এর অপেক্ষায় বসে না থেকে স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে পথ দেখানো উচিত।
সব চেয়ে চাঁছাছোলা ছিলেন মুর্শিদাবাদের এক নেতা। তিনি সরাসরিই বলেন, লোকের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে সিপিএমকে দিয়ে আর হবে না! এই ধারণা বদলাতে গেলে নিজেদের বদলাতে হবে। মুখ বদলাতে হবে, মন বদলাতে হবে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, কথায় কথায় বাম নেতারা চিনের দোহাই পাড়েন। কিন্তু চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক তথা প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর বয়স কত, তাঁরা ভেবে দেখেছেন? তরুণ রক্তকে দায়িত্ব দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করে ওই নেতার প্রস্তাব, নেতৃস্থানীয় পদে থাকার বয়সসীমা এখানেও বেঁধে দেওয়া হোক।
এঁরা কেউই সরাসরি বিমানবাবুর নাম করেননি। কিন্তু রাজ্য সম্পাদকের জবাব শুনে অধিকাংশ সদস্যই হতাশ হয়েছেন! বিমানবাবু বলেছেন, কর্মী ও সংগঠনের নিষ্ক্রিয়তার ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করতে হবে। নতুন মুখকে দলের কাজে গুরুত্ব দিতে হবে। সাংগঠনিক স্তরে কাজের অন্তর্বর্তী মূল্যায়নের (সচরাচর যা হয় বার্ষিক সদস্যপদ নবীকরণের সময়) জন্য আবার রাজ্য কমিটির বৈঠক বসবে। কমিটির এক সদস্যের প্রতিক্রিয়া, “একটা বৈঠক থেকে আর একটা বৈঠকের ঘোষণা। এ ভাবে কি ঘুরে দাঁড়ানো যায়?”
|