সেমিফাইনালে উইম কোভারম্যান্সের টিমের মুখোমুখি হওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই আলি আশফাক বলে দিলেন, “২০০৫ থেকে সাফে খেলছি। এত দুর্বল ভারতীয় টিম কখনও দেখিনি।”
দক্ষিণ এশিয়ার ‘বিস্ময়’ ফুটবলার বলা হচ্ছে মলদ্বীপের অধিনায়ক আশফাককে। শুধু ভাইচুং ভুটিয়া বা আই এম বিজয়ন নয়, সাফে খেলা সব স্ট্রাইকারের সব রেকর্ড দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছেন তিনি, কাঠমান্ডুতেই। দু’ম্যাচে তিনটে হ্যাটট্রিক-সহ দশ গোল করে সাফের ইতিহাসে এমন একটা মাইলস্টোন তৈরি করেছেন। সব মিলিয়ে সাফে আঠারো গোল হয়ে গেল আশফাকের।
ফুলহ্যামে খেলা পাকিস্তানের জৈস রহমান নয়। পর্তুগালে খেলে আসা সুনীল ছেত্রীও নয়। টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশি হইচই হচ্ছে আলি আশফাককে নিয়েই। নীচের দিকটা কালো, উপর দিকটা সাদাঅদ্ভুত চুলের স্টাইল তাঁকে আরও বেশি আলাদা করে দিচ্ছে। “রেকর্ড নয়, দেশকে চ্যাম্পিয়ন করাই আমার কাছে সবচেয়ে আগে। রেকর্ড তখনই দাম পায়, যদি সেই টিম চ্যাম্পিয়ন হয়,” বলে দিলেন মলদ্বীপের সবচেয়ে ‘দামি’ ফুটবলার।
শুক্রবার আফগানিস্তান-মলদ্বীপ ম্যাচ গোলশূন্য শেষ হওয়ায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ভারতের মুখোমুখি হল আশফাকের টিম। অন্য দিকে নেপাল খেলবে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। আশফাক কেমন খেলেন তা দেখতে দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে এসেছিলেন ভারতের ডাচ কোচ। কিন্তু টুর্নামেন্টের ‘বিস্ময় স্ট্রাইকার’-কে দেখা হয়নি তাঁর। কারণ সুনীল ছেত্রী হতে চাননি আশফাক। আগের ম্যাচে একটি হলুদ কার্ড দেখেছিলেন। এ দিন আর একটি কার্ড দেখলেই সেমিফাইনালে খেলা হত না আশফাকের। সে জন্যই সকালে কোচ উরবানিকে অনুরোধ করেন ম্যাচে না খেলানোর জন্য। কোচও ঝুঁকি নেননি। “আমার অনুরোধ টিমের সবাই মেনে নিয়েছে, পুরো এনার্জি নিয়ে খেলতে পারব সেমিফাইনাল,” বলছিলেন আশফাক। |
দুই ম্যাচে দশ গোল
ফুটছেন সাফের জাদুকর |
শ্রীলঙ্কা ম্যাচে জোড়া হ্যাটট্রিক করার পর সম্মান জানাতে ডিনারের আগে তাঁকে নতুন বুট পরিয়ে ফিতে বেঁধে দিয়েছিলেন দলের কোচ। এ দিন ছিল তাঁর জন্মদিন। রাতে হোটেলে সে জন্য বড় পার্টিও দেন সতীর্থরা। জন্মদিনে ভারতের মতো ‘দুর্বল’ প্রতিদ্বন্দ্বীকে পেয়ে গেলেন। ভারতকেই চাইছিলেন? আশফাক এ বার চূড়ান্ত পেশাদার, “ভারত খারাপ খেলছে ঠিক। কিন্তু ফুটবলে যে কোনও দিন যে কোনও অঘটন ঘটতে পারে। আমরা টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট। কিন্তু দু’দিন আগের ভুটান ম্যাচ আমাদের শিখিয়েছে, কাউকে ছোট করে দেখো না। ৮-২ জিতলেও ওই ম্যাচে আমরা এক সময় ২-১ পিছিয়ে ছিলাম।”
সাফ ও নেহরু কাপ মলদ্বীপ শেষ তিন সাক্ষাতেই হেরে গিয়েছে ভারতের কাছে। সে জন্য আশফাক-আক্রমরা এ বার পাল্টা দিতে মরিয়া। এবং তাঁদের সেই আশার অন্যতম কারণ অবশ্যই আশফাকের দুর্দান্ত ফর্ম। যে ক্লাবের হয়ে দেশে খেলেন, সেই নিউ রেডিয়্যান্ট এবং দেশের হয়ে এখন পর্যন্ত এই মরসুমেই ৫২ গোল করে ফেলেছেন আশফাক। ইস্টবেঙ্গল যেমন এএফসি কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে। আশফাকের ক্লাবও উঠেছে। “এই মরসুমটা আমার কেরিয়ারের সেরা মরসুম। ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটা আমরা জিততে চাই।” বলছিলেন তিনি। সেমিফাইনালে ভারত অধিনায়কের না থাকাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ টুর্নামেন্টের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফুটবলার। বলছিলেন, “ফুটবলটা এগারো জনের খেলা। কেউ একা খেলে না।”
কোচ মাঠে গেলেও ভারতীয় ফুটবলাররা হোটেলে বসে টিভিতে ম্যাচ দেখেন এ দিন। মলদ্বীপ সামনে পড়ে যাওয়ায় কী ভাবে আশফাককে আটকানো হবে, তা নিয়ে চিন্তায় পুরো টিম। সবথেকে চাপে সম্ভবত দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে কার্ড দেখে বাইরে চলে যাওয়া সুনীল ছেত্রী। প্রচুর সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি শেষ তিন ম্যাচে। গোল মাত্র একটি। টিম সূত্রের খবর, সে জন্যই লাঞ্চ থেকে ডিনার টেবল যেখানেই দেখা হচ্ছে, সেখানেই সিনিয়র ফুটবলারদের সমালোচিত সুনীল অনুরোধ করছেন, যে করে হোক জিততেই হবে।
তীব্র চাপে কোভারম্যান্সও। মলদ্বীপ ম্যাচ দেখে বেরোনোর মুখে সোমবারের প্রতিপক্ষ নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও কোনও কথা বলতে চাননি। মিডিয়ার লোকজন দেখলেই হাসিখুশি মুখ গোমড়া হয়ে যাচ্ছে ডাচ কোচের। বেঙ্গালুরুর শিবিরে অনুমতি ছাড়া মিডিয়ার সঙ্গে কথা বললে শাস্তি পেতে হবে, ছাত্রদের বলে দিয়েছিলেন কোভারম্যান্স। রীতিমতো ক্লাস করে। কী বলতে হবে, তা-ও শেখানো হয়েছিল। ফলে ফুটবলাররা গোপনে অনেক কিছু বললেও, সরকারি ভাবে কিছু বলছেন না। আর যাঁদের পাঠানো হচ্ছে তাঁরা ফতোয়া মেনে এমন নির্বিষ উত্তর দিচ্ছেন যে, নিজেরাই হেসে ফেলছেন।
এ দিন অনুশীলনের আগে যেমন পাঠানো হয়েছিল জুয়েল রাজা এবং জেজে-কে। দু’জনেই বললেন, “সেমিফাইনালে কোচ নিশ্চয়ই অন্য স্ট্র্যাটেজিতে খেলাবেন। ম্যাচটা জিততে হবে। আমাদের একটু খারাপ সময় যাচ্ছে”। জেজে-কে প্রশ্ন করা হল, নেপালের বিরুদ্ধে ৪-৪-২ খেলার পর ভারতের খেলায় সামান্য উন্নতি হয়েছিল। মাঝমাঠের বদলে স্ট্রাইকার খেলতে কি স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন? ফুটবলারটি বলে দেন, “কোচ যেখানে বলবেন সেখানেই স্বচ্ছন্দ আমি।” তার পর নিজেই হাসতে থাকেন।
কিন্তু ফতোয়া জারি করে কত দিন বন্ধ করে রাখা যাবে ফুটবলারদের মুখ? টিমের সবচেয়ে সিনিয়র সন্দীপ নন্দী খেলছেন না। ফলে সুনীলের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র রহিম নবিরই অধিনায়ক হওয়ার কথা। কিন্তু সম্ভবত তা করা হচ্ছে গৌরমাঙ্গীকেই। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই টিম ইন্ডিয়ার মধ্যে ঝড় উঠতে শুরু করেছে। |