বসার ঘরে বইয়ের র্যাকে ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’। টেবিলে রাখা ফোটো অ্যালবামে পরিজনদের সঙ্গে তাঁর নানা মুহূর্ত। বাগুইআটির তিনতলার তিন কামরার ফ্ল্যাটে স্মৃতি হয়েই ছড়িয়ে রয়েছেন সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মা মারা গিয়েছেন বছর দুয়েক আগে। গত মার্চে বাবাও। নিকট আত্মীয় বলতে দুই ভাই। এক ভাই সুবল থাকেন তারাপীঠে। আর এক ভাই বাগুইআটির বাসিন্দা, পেশায় প্রোমোটার গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় অ্যালবামের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, “দিদি আমার থেকে প্রায় দশ বছরের বড়। সেই কারণে ছোটবেলায় ওকে বেশ ভয়ই পেতাম। কিন্তু বয়স বাড়ার পরে ব্যাপারটা
উল্টে যায়। আমিই দিদির অভিভাবকের মতো হয়ে যাই। গত ফেব্রুয়ারিতে যখন বলল ফের কাবুল যাব, বারণ করেছিলাম।”
বারণ করাটা স্বাভাবিক। কম যন্ত্রণা তো ভোগ করতে হয়নি সেই বিদেশ-বিভুঁইয়ে। ১৯৯৫ সালে শ্বশুরবাড়ি থেকে পালানো। ধরা পড়ে আবার শ্বশুরবাড়ি ফেরা। বন্দিজীবন। আবার পালানো। তালিবানের মুখে পড়া। কোনও মতে রক্ষা পেয়ে শেষ পর্যন্ত স্বভূমে।
এ দফায় কিন্তু তেমন কোনও অসহনীয় পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি বলেই গোপালবাবুদের জানিয়েছিলেন সুস্মিতা। বরং বারবার বলেছিলেন, এখন অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি। গোপালবাবুর কথায়, “বাবা মারা যাওয়ার পরে গত জুলাইয়ে চার দিনের জন্য কলকাতায় এসেছিল দিদি। তখন ওর চোখে মুখে অন্য রকম একটা উচ্ছ্বাস দেখেছিলাম। বলেছিল, ভাই, কাবুল কিছুটা হলেও পাল্টেছে। তবে এখনও মহিলাদের অবস্থা ভাল নয়। মহিলাদের সামাজিক অবস্থা নিয়ে আমি কিছু ছবি তুলছি। নতুন এক নেশায় পেয়েছিল দিদিকে। যেন একটা নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন বই লেখার পরিকল্পনাও ছিল।”
গত কয়েক দিনে পরিস্থিতির কিছু বদল হয়েছে, এমন ইঙ্গিতও পাননি বলে দাবি করছেন গোপালবাবুরা। তাঁর স্ত্রী দেবলীনা বলেন, “দিন দশেক আগে ফোনে কথা হয়েছিল। তখনও ওর গলা শুনে এক বারের জন্যও মনে হয়নি যে কোনও রকম ভয় বা চাপের মধ্যে রয়েছে।” |
সুস্মিতার ভাই গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী দেবলীনা। শুক্রবার বাগুইআটির বাড়িতে। ছবি: শৌভিক দে। |
তেজারতি কারবারের সঙ্গে জামাকাপড়ের ব্যবসাও করেন সুস্মিতার স্বামী জানবাজ। সে জন্য জুলাইয়ে কলকাতায় এসে নিউ মার্কেট থেকে বাচ্চা ও মেয়েদের জন্য প্রচুর পোশাক কিনেছিলেন সুস্মিতা। শুধু স্বামীর ব্যবসায় সাহায্য করা নয়, প্যারামেডিক্যাল প্রশিক্ষণ থাকায় শ্বশুরবাড়ির দেশে মেয়েদের প্রাথমিক চিকিৎসাও করতেন তিনি।
এই নানা ধরনের কাজের সঙ্গে সুস্মিতার জড়িয়ে যাওয়াকে তাঁর স্বামী ও পরিবার ভাল চোখেই দেখতেন বলে দাবি গোপালবাবুদের। দেবলীনা বলেন, “জুলাইয়ে এসে শ্বশুরবাড়ির অনেক গল্প করছিল। বলেছিল শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ওর কাজে খুবই উৎসাহ দেয়। বিশেষ করে ওখানকার মেয়েদের চিকিৎসা করার কাজে।”
আফগানিস্তানে ‘সুখে’ থাকলেও দেশের সঙ্গে নাড়ির টান ছিল সুস্মিতার। বারেবারেই ছুটে আসতেন কলকাতায়। “শেষ বার যখন কথা হয়, দিদি বলেছিল ভাইফোঁটায় আসবে। প্রতি বছরের মতো এ বারও বাগুইআটির ফ্ল্যাটে ভাইফোঁটার জমজমাট অনুষ্ঠান করা হবে।” গোপালবাবু বলেন, “আমরা বলেছিলাম এই কিছু দিন আগেই তো ঘুরে গেলি। আবার এত খরচ করে আসার কী দরকার? কিন্তু ও কোনও কথাই শুনতে চায়নি। বলেছিল, প্রতিবারই ভাইফোঁটা করি। এ বারও মিস করব না।”
কথা রাখা হল না সুস্মিতার।
|