দার্জিলিং নিয়ে দিল্লির ভূমিকায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রীতিমতো ক্রুদ্ধ। বর্তমান পরিস্থিতিতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রতিনিধিদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে কেন দেখা করলেন, মমতা প্রশ্ন তুলেছেন তা নিয়ে। কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্র বা অন্য মন্ত্রীরা মোর্চা নেতাদের সঙ্গে ঘনঘন বৈঠক করলে তাঁদের আন্দোলনে ‘ইন্ধন’ জোগানো হয় বলে কয়েক দিন আগেই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, রাজ্যকে বাদ দিয়ে আর এমন কোনও বৈঠক হবে না। তা সত্ত্বেও মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মোর্চা নেতাদের বৈঠককে তাই মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিতে পারছেন না।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য মোর্চা নেতাদের বলেছেন, আগে তাঁদের বন্ধ তুলতে হবে। তার পরে কথা। কিন্তু মমতার বক্তব্য, শিন্দে কী বলেছেন, সেটা বড় কথা নয়। কেন দেখা করবেন, সেটাই আসল। তা ছাড়া মোর্চা বন্ধ তুললে যে কথা হতে পারে, সেটাও রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে কেন্দ্র বলে কী করে? মমতার ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর এই মনোভাব দিল্লির কানে তোলা হয়েছে।
পাশাপাশি তৃণমূল নেতৃত্বকে মমতার নির্দেশ, রাজনৈতিক ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার ও কংগ্রেসের ভূমিকার প্রতিবাদ করে বলতে হবে, ‘গোর্খাল্যান্ডের দাবিদারদের নিয়ে কংগ্রেস এই ভাবে বাংলা ভাঙার খেলা খেলছে। কোনও মতেই তা বরদাস্ত করা হবে না।’
লেপচা সম্প্রদায়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সম্মান গ্রহণ করতে মুখ্যমন্ত্রী সোমবার কালিম্পং গিয়েছিলেন। তার আগের দিন মোর্চার নেতাদের দিল্লি পাঠিয়ে দেন বিমল গুরুঙ্গ। |
মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ে পৌঁছেই খবর পান, দিল্লিতে এআইসিসি-র পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সি পি জোশী সেদিনই মোর্চা নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং মঙ্গলবার তাঁদের সঙ্গে দেখা করবেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর ক্ষোভ শুরু হয় তখন থেকে। কারণ মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, শীর্ষস্তরের কোনও কংগ্রেস নেতা বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আন্দোলনকারী মোর্চা নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে তার অর্থ হয়, বিমল গুরুঙ্গদের ‘অহেতুক গুরুত্ব’ দেওয়া। তৃণমূল সূত্রে এমনও বলা হয় যে, মোর্চা নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনায় বসা আসলে কংগ্রেসের দলীয় সিদ্ধান্ত।
কী ভাবে এই ধারণায় পৌঁছলেন মমতা?
মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের ব্যাখ্যা হল, মোর্চার আন্দোলন যে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে, তার ইঙ্গিত কয়েক দিন ধরেই স্পষ্ট। মুখ্যমন্ত্রীর সফরের সময় মোর্চা পাহাড়বাসীদের ‘ঘরের ভিতরে থাকা’র ডাক দিলেও তাঁর যাত্রাপথে মুখ্যমন্ত্রী বিপুল অভিনন্দন পেয়েছেন। তিনি দেখতে পেয়েছেন, পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে দোকানপাট আপাত ভাবে বন্ধ মনে হলেও বহু জায়গায় ঝাঁপ আধখানা খোলা ছিল। সাধারণ লোক বাড়ির সামনে বেরিয়ে এসে, ছাদে বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছেন। দেখেশুনে মুখ্যমন্ত্রীর দৃঢ় ধারণা হয়েছে, গুরুঙ্গদের বিরুদ্ধে পাহাড়ের মানুষ এ বার মাথা তুলছে।
এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লেপচা ও তামাঙ্গ সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন। লেপচাদের জন্য পৃথক উন্নয়ন পরিষদ গঠন করা হয়েছে এক বছর আগেই। এ বার লেপচাদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে তামাঙ্গ উপজাতিদের সঙ্গেও মমতা আলাদা ভাবে দেখা করে তাঁদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। আন্দোলনকারী গোর্খাদের মোকাবিলায় লেপচা ও তামাঙ্গদের মিলিত জনসমর্থন কাজে আসবে ধরে নিয়ে তাই তাঁর কাছে এটা আরও বেশি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, অঙ্কের হিসেবেও মোর্চার জমি আর আগের মতো শক্ত থাকবে না।
এই পরিস্থিতিতে দিল্লি কেন মোর্চা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে গেল? এর পিছনেই কংগ্রেসের ‘সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক খেলা’ দেখছেন মুখ্যমন্ত্রী। দলীয় নেতাদের তিনি বলেছেন, শিন্দের সঙ্গে বৈঠক করে মোর্চা নেতারা ‘খুশি’ হয়েছেন। যদি সেখান থেকে মোর্চাকে কোনও আশ্বাস দেওয়া হয়ে থাকে, তা হলে রাজ্য সরকারের ভূমিকা কী? রাজ্য কেন কিছু জানবে না? রাজ্যের সঙ্গে কথা না বলে কীসের ভিত্তিতে কেন্দ্র কথা বলে? জিটিএ চুক্তির পরে মাস ছয়েক অন্তর রাজ্য, কেন্দ্র ও জিটিএ প্রতিনিধিরা বৈঠক করে থাকেন। মাস দুয়েক আগেই এক বার তেমন একটি বৈঠক হয়েছে। এখন কেন্দ্র শুধু ওদের নিয়ে বসল কেন? এ সব কথা বলে মানুষকে বোঝাতে হবে, মোর্চাকে উস্কানি দেওয়ার পিছনে রয়েছে কংগ্রেস ও কেন্দ্র।
|