বেলা একটা পঁয়তাল্লিশ। টিফিনের ঘণ্টা বাজতেই সাড়ে তিনশো পড়ুয়া হাত ধুয়ে থালা নিয়ে সোজা লাইনে। একে একে পাতে পড়ল ভাত, ডাল, আলু-কুমড়ো-ছোলার তরকারি। তৃপ্তি করে খেল ছেলেমেয়েরা। রোজই মি ডে মিলের এই ছবি দেখা যায় পুরুলিয়া শহরের শিশুশিক্ষা কেন্দ্র নিম্ন বুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আগুন বাজার আর সামান্য বরাদ্দের জন্য যেখানে বেশিরভাগ স্কুলে মি ডে মিল চালাতে মাস্টারমশাইদের হাঁসফাঁস দশা, সেখানে এমন দৃশ্য সত্যিই ব্যতিক্রমী।
সরকারি হিসেব অনুযায়ী মিড ডে মিলের জন্য ছাত্রপিছু দিনে বরাদ্দ ৩.৫১ টাকা। এই টাকাতেই সব্জি, ডিম, তেল, মশলা কিনতে হয়। ব্যবস্থা করতে হয় জ্বালানির। সরকার শুধু চাল দেয়। মাথাপিছু চাল বরাদ্দ দিনে ১০০ গ্রাম। রাঁধুনিদের বেতনও সরকার দেয়। যৎসামান্য বরাদ্দে মিড ডে মিল চালাতে গিয়ে বহু স্কুলেই দেখা যায় অযত্নের ছবি। ডালে টিকটিকি থেকে মিড ডে মিল খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে বারবার। সম্প্রতি বিহারের ছপরায় মিড ডে মিলে শিশু মৃত্যুর ঘটনা তারই চূড়ান্ত পরিণাম। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা একে বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন। সব মিলিয়ে মনে করা হয় মিড ডে মিল প্রকল্পটা নিজেই একটা সঙ্কট। অথচ এ রাজ্যেই রয়েছে এর বিপরীত ছবি। বেশ কিছু স্কুলে সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যেও সফল ভাবে মিড ডে মিল চলছে। কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা তো আছেই, সেই সঙ্গে গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সকলের মধ্যে নিয়মিত সমন্বয়ের ফলে তা সম্ভব হচ্ছে। |
আলিপুরদুয়ার হাইস্কুলে মিড ডে মিল খাচ্ছে পড়ুয়ারা। —নিজস্ব চিত্র। |
পুরুলিয়ার নিম্ন বুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল বলেন, “আমরা সব শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে মিড ডে মিল দেখভাল করি। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর পাঁচ জন মহিলা রান্নার কাজ সামলান। বাজারহাটও তাঁরাই করেন।” অভিভাবকদের থেকেও পরামর্শ নেন কর্তৃপক্ষ। স্কুল পরিচালন সমিতির সম্পাদক বিভাস দাস বলেন, “অভিভাবকেরা মিড-ডে মিল নিয়ে নানা প্রস্তাব দেন। আমরা তা মানি।” রান্নার দায়িত্বে থাকা গায়ত্রী দত্ত জানালেন, কতজন পড়ুয়া স্কুলে এসেছে তা দেখেই রান্না চড়ানো হয়। প্রতিদিন তো সব ছাত্র আসে না। কিন্তু টাকা বরাদ্দ হয় সকলের জন্য। তাই হিসেব করে রান্না চাপালে সুবিধা হয়।
এই অঙ্কেই সফল ভাবে মিড ডে মিল চালাচ্ছেন পুরুলিয়ারই ঝালদা-২ ব্লকের জিউদারু প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এখানে পড়ুয়া ৩২৪ জন। প্রধান শিক্ষিকা রূপালি সেন বলেন, “বরাদ্দ টাকা যথেষ্ট নয় ঠিকই। কিন্তু একটু হিসেব করে চললে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ডাল, ভাত, সব্জি রাখাই যায়। স্থানীয় বাজারে সব্জির দাম কম। আমরা চেষ্টা করি মরসুমি সব্জি কিনতে। তাতে সুবিধা হয়।” সে জন্যই রূপালিদেবীরা পড়ুয়াদের আলু-সয়াবিনের তরকারি, লাউ-চিংড়ি খাওয়াতে পারেন। মাঝেমধ্যে ডিমও খাওয়ানো হয়।
পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি দেশপ্রাণ ব্লকে চণ্ডীভেটিবাড় প্রাথমিক স্কুলে আবার মিড ডে মিলের কথা ভেবে স্কুল সংলগ্ন ৫০ ডেসিমেল জমিতে সব্জি বাগান করা হয়েছে। ৮ ডেসিমেল পুকুরে হয় মাছ চাষ। বাগান দেখভালের দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদের। প্রত্যেকের নামে নামে গাছ রয়েছে। যার গাছ সব থেকে ভাল, তাকে পুরস্কৃত করা হয়। অভিভাবক ও গ্রামবাসীরাও এই কর্মযজ্ঞে সামিল হয়েছেন। গোটা প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ‘কাজলা জনকল্যাণ সমিতি’র। সমিতির সম্পাদক স্বপন পণ্ডার মতে, “মিড ডে মিলের উদ্দেশ্য শুধু ছাত্রছাত্রীদের পেট ভরানো নয়, পুষ্টিকর খাবার দেওয়া। সে ক্ষেত্রে এই স্কুল নজির গড়তে পেরেছে। সমিতির পক্ষ থেকে ব্লকেরই আরও ৪টি প্রাথমিক স্কুলকে ‘মডেল’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে।”
জলঙ্গি সাগরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রদ্যুৎ সরকার। তাঁর যুক্তি, “রাঁধুনিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চললে ওই পয়সাতেই ভাল খাবার দেওয়া যায়। তবে মাংস বা মাছ খাওয়াতে গেলে সপ্তাহে একদিন বরাদ্দ ডিম বন্ধ রাখতে হয়। সপ্তাহ দুয়েক ডিম বন্ধ রাখলে একদিন মাংসও খাওয়ানো যায়। তাছাড়া একদিন খিচুড়ি খাওয়ালে কিছুটা পয়সা বাঁচে।” এই স্কুলে ৩০২ জন ছাত্র। নিয়ম মেনে টাকা বাঁচিয়ে দু’মাসে একদিন মাংস বা মাছ খাওয়ানোও হয়।
আলিপুরদুয়ার হাইস্কুলেও পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সাতশো ছাত্রকে মিড ডে মিল খাওয়ানো হয় নিয়মিত। প্রধান শিক্ষক শান্তনু দত্ত বলেন, “সব শিক্ষকের দায়বদ্ধতা রয়েছে বলেই মিড-ডে মিল পরিচালনার ক্ষেত্রে আমার অনেকটাই সফল। আলাদা রান্নাঘরে ১০ জন মহিলা রান্না করেন। রয়েছে গ্যাস ওভেন, জল তোলার পাম্প। ডাইনিং হলও আছে। স্কুলের ৫৫ শিক্ষককে মিড ডে মিল দেখভালের দ্বায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন ছ’জন করে শিক্ষক পালা করে রান্না থেকে ছাত্রদের খাওয়া তদারকি করেন।” হিসেব করে চলেই ডিম, সয়াবিন, আলুসেদ্ধ, লাবড়া, আলু-পটল, স্কোয়াশের তরকারির মতো রকমারি খাবার ছাত্রদের দেওয়া হয়। অষ্টম শ্রেণির আশিস দত্ত, শুভঙ্কর দাস, সপ্তম শ্রেণির রাহুল রায়ের কথায়, “পরিষ্কার থালায় বাড়ির মতোই ভাত-তরকারি খাই। স্যারেরা খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে দেখেন।”
সব মিলিয়ে এটা পরিষ্কার ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। দরকার শুধু সেই আন্তরিক ইচ্ছের।
(তথ্য সহায়তা: প্রশান্ত পাল, নারায়ণ দে, সুজাউদ্দিন, সুব্রত গুহ) |