দৃষ্টির ধারে কাছে কোনও ডাঙা নেই। আদিগন্ত বিস্তৃত কেবল জল আর জল। পদ্মার সেই সর্বগ্রাসী খরস্রোতা জলরাশির মধ্যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো কোনও মতে জেগে আছে করগোটেড শিটের ছাউনি। সেই ছাউনির নিচে মেঝেতেও জলের ধারা। সেই জলজঙ্গলের মধ্যেই সাপখোপ সঙ্গী করে প্রাণ বাজি রেখে সপ্তাহ দুয়েক কোনও মতে নিজেদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রেখেছেন বাংলাদেশের সীমানা লাগোয়া নির্মলচরের ১৩ হাজার মানুষ। বানের জলে একাকার হয়ে যাওয়ার ফলে সীমানা বলে কিছু নেই। রানিতলা থানা এলাকার নির্মলচরের মদনঘাট আর মাঝেরচরে ছিল বিএসএফের দু’টি সীমান্ত চৌকি। বন্যা ও ভাঙনে সে সব এখন লোপাট। ২০০৭ সালের ২৮ অগস্ট ‘নির্মলচর বন্যাশ্রয় গৃহ’ নামে তিনতলা দু’টি ‘ফ্লাড শেল্টার’ উদ্বোধন করা হয়। সেই ‘নির্মলচর বন্যাশ্রয় গৃহ’-এ এখন নির্মলচরের বন্যাকবলিতদেরই থাকার কোনও অধিকার নেই। দু’টি ‘ফ্লাড শেল্টার’ই এখন বি এস এফের দখলে। |
তার মধ্যে মাঝেরচরে ‘ফ্লাড শেল্টার’-এর এক তলা পদ্মার জলে ডুবে গিয়েছে। দো-তলা ও তিনতলায় আছেন বি এস এফের ৯১ নম্বর ব্যাটেলিয়নের জনা পঞ্চাশেক জওয়ান। বছর পাঁচেক আগে ওই ব্যাটেলিয়নের সীমান্ত চৌকি পদ্মার শাখা নদীর ভাঙনে তলিয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে ফ্লাড শেল্টারটি জওয়ানদের দখলে। বি এস এফের ওই সীমান্ত চৌকির ইনচার্জ প্রমোদকুমার পাঠক বলেন, “আমরাও তো বন্যাকবলিত। কোথাও ডাঙা নেই। আমরা থাকব কোথায়?” সেখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে রয়েছে মদনঘাট ফ্লাড শেল্টার। সরকারি পরিভাষায় তিনতলা ওই ‘ফ্লাড শেল্টার’-এর নাম ‘নির্মলচর বন্যাশ্রয় গৃহ’। সেই ভবনটি মাস তিনেক থেকে চলে গিয়েছে বি এস এফের ৮৫ নম্বর ব্যাটেলিয়নের ৮০ জন জওয়ানের দখলে।
আপাতত লালবাগের ভারপ্রাপ্ত এস ডি ও তারক মল্লিক। দিন পাঁচেক আগে তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি বলেন, “বন্যার আগে যখন ফ্লাড শেল্টার ফাঁকা ছিল তখন জওয়ানাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল। তার পর এখন তো জওয়ানরাও বন্যা কবলিত। তবুও ফ্লাড শেল্টার-এর বিষয়টি নিয়ে জেলাশাসকের সঙ্গে কথা বলব।” স্থানীয় ভগবানগোলা ২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সহকারি সভাপতি সি পি এমের রিয়াজুদ্দিন শেখ বলেন, “নির্মলচরের বন্যাকবলিত মানুষদের জন্য ফ্লাড শেল্টার দু’টি গড়া হয়েছে। সেই বন্যাদুর্গতদের জন্য ফ্লাড শেল্টার দু’টি ছেড়ে দিতে মহকুমাশাসকের কাছে অনুরোধ করেছি।” ফ্লাড শেল্টার থেকে গজ দশেক দূরে রয়েছে পবন মণ্ডল, কোকারাম মণ্ডলদের জলে ডুবে যাওয়া বাড়ি। বাড়ির উঠোনে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে কোমর সমান উঁচু মাচা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে গাদাগাদি করে কোনও মতে গরু, ছাগল ও ভেড়া থাকার জায়গা করা হয়েছে।
তাঁদের বাড়ির অদূরেই থাকা একতলা শিশুশিক্ষা কেন্দ্র এক বুক জলের তলায়। পাশেই দোতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও তার একতলা জলমগ্ন। জলের তোড়ে তার মেঝেতে ধস নেমেছে। ফলে মা অলকা মণ্ডল তাঁর বছর আটেকের মেয়ে সঞ্চিতাকে নিয়ে হাঁটু সমান জলে থই থই কুঁড়েঘরেই জীবন বাজি রেখে তাঁদের দিন গুজরান। এস ডি ও বলেন, “কুড়ি কুইন্টাল চাল আর ২০০টি তারপলিন মজুত ছিল। সে গুলি দেওয়া হয়েছে। আরও বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে জেলা থেকে।”
পঞ্চায়েত সমিতির সহকারি সভাপতি রিয়াজুদ্দিন শেখ বলেন, “নির্মলচরের ১৩ হাজার লোকের জন্য ২০ কুইন্টাল চাল মানে তো মাথা পিছু ১৫৩ গ্রাম। আর ২২০০ পরিবারের জন্য ২০০ তারপলিন। তাই মারধর খাওয়ার ভয়ে নিমর্লচরে গিয়ে সে সব বণ্টন করার সাহস করেনি কোন জনপ্রতিনিধি।” পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য কংগ্রেসের ঊর্মিলা মণ্ডলের বাড়ি নির্মলচরে। তিনি বলেন, “নৌকা, পানীয় জলের কষ্ট সব চেয়ে বেশি। যে ভাবে পদ্মার জল বেড়েই চলছে তাতে দ্রুত পানীয় জল ও নৌকা না দিলে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে যাবে।” |