স্টেডিয়াম থেকে স্পষ্ট দেখা যায় উঁচু পাহাড়ের উপর নেপালের বিখ্যাত বুদ্ধমন্দিরস্বয়ম্ভূনাথ! শান্তির খোঁজে সেখানে প্রতিদিন আসেন দেশ-বিদেশের মানুষ। স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তা দিয়ে তাঁরা দলে দলে যাচ্ছিলেন মঙ্গলবার বিকেলেও।
সেই পাহাড়ের কোলেই আলচক পুলিশ স্টেডিয়ামে এ দিন অশান্তির আবহ!
খেলা শেষের সঙ্গে সঙ্গেই রেফারিকে গালাগালি দিতে দিতে একের পর এক জলের বোতলে লাথি মারছিলেন বাংলাদেশ টিমের সহকারী ডাচ কোচ। এর পরই তাঁর পাশ থেকে ম্যানেজার-সহ টিম ম্যানেজমেন্টের একাংশের ‘পয়সা খাইসে’, ‘টাকা খাইসে’ বলে রে রে করে শ্রীলঙ্কার রেফারি ক্রিশান্ত ডি পেরিরার দিকে তেড়ে যেতে দেখা গেল। বাংলাদেশের গোলের পর তাদের কোচকে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেন রেফারি। যে রাগটা বোঝা গেল ম্যাচের পরেও যায়নি। এবং এর রেশ মিটতে না মিটতেই উলটো দিকে ভারতের ডাগআউটে নিজেদের মধ্যে ঝামেলায় জড়ালেন দুই ফুটবলার— মেহতাব হোসেন এবং মোহনরাজ।
মোহনরাজ তেড়ে গেলেন মেহতাবের দিকে। পাল্টা তেড়ে গেলেন মেহতাবও। জাতীয় দলের লেফট ব্যাক দক্ষিণের ছেলে মোহনরাজকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, “বাঙালি দিমাগ ইয়াহাঁ মত চালানা।” (বাঙালি বুদ্ধি এখানে খাটাস না।) যা শুনে প্রচণ্ড ক্ষেপে যান দলের অন্যতম সিনিয়র মেহতাব। ড্রেসিংরুমের দিকে একটু এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মোহনরাজের কথা শুনে তিনিও পাল্টা তেড়ে যান। মুখোমুখি দু’জনে তখন প্রায় রণং দেহি মূর্তিতে। রহিম নবি এবং নির্মল ছেত্রী দু’জনকে দু’দিকে সরিয়ে না নিলে হাতাহাতি অনিবার্য ছিল।
উইম কোভারম্যান্সের তেরো মাসের জমানায় যা কখনও ঘটেনি, হঠাৎই সেই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় তীব্র অস্বস্তিতে ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট। মাঠের এক কোণে নিয়ে গিয়ে মোহনরাজের কাছে ঘটনাটা কী, তা জানতে চান ডাচ কোচ। আষাঢ়ে মেঘের মুখ নিয়ে সহকারী কোচ স্যাভিও মেদেইরার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথাও বলতে দেখা যায় তাঁকে। কোচ বারণ করে দেওয়ায় মোহনরাজ মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেননি। টিম সূত্রের খবর, কোচের কাছে মোহনরাজ অভিযোগ করেছেন, মাঠের মধ্যে মেহতাব তাঁকে গালাগালি করেছেন। বাংলাদেশের কোনও ফুটবলারকে ঠিকঠাক ট্যাকল করতে না পারলে বা একটু উঠে গেলেই তাঁকে যা-তা বলেছেন। ভারতীয় দল যখন ড্রেসিংরুম ছেড়ে টিম বাসের দিকে যাচ্ছে, তখন দেখা যায় আঙুল তুলে মেহতাবকে কিছু বলছেন কোভারম্যান্স। অনেকটা ধমকের ভঙ্গিতে। মেহতাব অবশ্য বলেন, “ও একটু মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। তাই হয়ে গিয়েছে।” মোহনরাজকে দেখা যায় টিম বাসের পিছনে মুখ কালো করে বসে থাকতে।
কোভারম্যান্সকে এ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ পায়নি মিডিয়া। কেন রহিম নবিকে বসিয়ে মোহনরাজকে খেলিয়ে যাচ্ছেন? এই প্রশ্নে ডাচ কোচ যে ভাবে মেজাজ হারালেন এবং সাংবাদিকদের এ রকম ‘স্টুপিড কোয়েশ্চেন’ করতে বারণ করলেন, তার পর কেউ আর এগোননি। তবে জাতীয় দলের হয়ে গোলসংখ্যায় এ দিন আই এম বিজয়নকে (৪০) টপকে যাওয়া সুনীল ছেত্রী (৪১) মজা করে বললেন, “দু’জনের মধ্যে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। কে কাকে মেসেজ করেছে তা নিয়েই ঝামেলা।” রাতে অবশ্য ডিনারে মেহতাব ও মোহনরাজকে এক টেবিলে বসে খেতে দেখা যায়। এক সঙ্গে আইস বাথও নেন। শোনা যাচ্ছে সেটা কোচের নির্দেশেই। টিম ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে বোঝানোর চেষ্টা হয়, গুরুতর কিছু নয়। ম্যাচের পর ঘটনাটা অবশ্য ঘটে সব ভারতীয় সাংবাদিকদের সামনেই।
কিন্তু এই ঝামেলা মিটে গেলেও এর রেশ কি ভারতীয় দলের উপর পড়বে? কোভারম্যান্স যে ভাবে টিম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন এবং সাফ কাপের সেমিফাইনালে উঠতেই হামাগুড়ি খাচ্ছেন তাতে শোনা যাচ্ছে, টিমের মধ্যে বারুদ একটু একটু করে জমছে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, কেন পজিটিভ স্ট্রাইকার জেজে মাঝমাঠে? কেন ক্লাব দলে মিডিও জুয়েল রাজা সেকেন্ড স্ট্রাইকার? কেন সবথেকে ইউটিলিটি ফুটবলার নবিকে বসিয়ে রেখে মোহনরাজকে খেলিয়ে যাওয়া হচ্ছে? নবি তো এ দিন খেলা শেষের পর কিছুটা অভিমান মিশ্রিত গলায় দলের ফিজিওকে বললেন, “চলুন প্র্যাক্টিসেই নেমে পড়ি।” |
যত বিতর্ক কাঠমান্ডুতে |
ম্যাচের শেষে
|
• মেহতাব-মোহনরাজ ঝামেলা।
• মেহতাবের নামে কোচের কাছে অভিযোগ মোহনরাজের।
• মিডিয়ার প্রশ্নে কোভারম্যান্সের মাথা গরম করা। |
|
ম্যাচে |
• দল নির্বাচনে প্রথম এগারো ঠিকঠাক নামাতে না পারা। বদলিও ঠিক হয়নি।
• টিম ফর্মেশনে ভুল। জেজে মাঝমাঠে, জুয়েল সেকেন্ড স্ট্রাইকার।
• ভুল স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আকাশে বল রেখে আক্রমণে যাওয়া।
লম্বা ফুটবলার না থাকায় যা কাজে দেয়নি। |
|
কেন নবি বাদ? কোভারম্যান্সের গম্ভীর মুখ থেকে বেরিয়ে এল অদ্ভুত ব্যাখ্যা, “ও ম্যাচ খেলার মধ্যে নেই।” পাল্টা প্রশ্ন করা হল, মোহনরাজও তো ম্যাচ খেলেননি বহু দিন? “ও জুনিয়র, পজিটিভ লেফট ব্যাক। এ রকম স্টুপিড প্রশ্ন আর করবেন না।”
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভাগ্যক্রমে আত্মঘাতী গোলে জয়। এ দিনও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সুনীল ছেত্রীর অসাধারণ ফ্রিকিকে হার বাঁচানো। তার উপর অন্য ম্যাচে পাকিস্তান এবং নেপালের খেলা ১-১ ড্র। পরিস্থিতি যা তাতে নেপালের সঙ্গে বৃহস্পতিবার শেষ ম্যাচ ড্র করলেই শেষ চারে যেতে পারবে ভারত। তবে গ্রুপের দ্বিতীয় হয়ে। নেহরু কাপের মতোই ‘লাক’ এখানেও সঙ্গী হচ্ছে কোভারম্যান্সের। কিন্তু সেমিফাইনালে উঠলে উল্টো দিকে তো রয়েছে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা আফগানিস্তান ও মলদ্বীপ। ভারত পরপর দু’টো ম্যাচে যা খেলল তাতে কিন্তু তাদের ‘ব্যথা’ আছে।
কোভারম্যান্স অবশ্য ভাগ্যের জন্য টুনার্মেন্টে টিঁকে রয়েছেন মানতে নারাজ। প্রথমে ‘লাক-এর জন্য আজ পয়েন্ট পেয়েছি’ বলেও পরে শুধরে নিয়ে বললেন, “আমি লাকে বিশ্বাস করি না। আমরা অন্তত দশ-বারোটা গোলের সুযোগ পেয়েছি। চার-পাঁচটা গোল তো হতই। খেলার শেষ মিনিটও তো ম্যাচের মধ্যেই। ভাল খেললে কেউ মনে রাখে না। জিতলে মনে রাখে। আমি আশাবাদী নেপালের বিরুদ্ধে তিন নম্বর ফাইনাল খেলে শেষ চারে যাব।”
শেষ চারে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত সুনীল ছেত্রীও। বলছিলেন, “ফ্রিকিকটা মারার সময় বিজয়নের কথা বা রেকর্ডের কথা মনে হচ্ছিল না। আমরা গোল করতে পারছি না বলেই সমস্যা হচ্ছে। দু’টো ম্যাচেই এ জন্য সমস্যা হল।” ভারত অধিনায়ক স্বীকার করে নেন, “সুযোগগুলো কাজে না লাগায় পুরো দল হতাশ হয়ে পড়ছে। তা নিয়ে পরে নানা সমস্যা তৈরি করছে।”
কোভারম্যান্স এবং সুনীলের গলায় একই সিডি বাজছে। সেটা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের যা অবস্থা তাতে কাঠমান্ডুতে সাফ জয়ের হ্যাটট্রিক হলে সেটা কিন্তু বড় অঘটন হবে। |