প্রবন্ধ ২...
মুখের ওপর প্রশ্ন তুললে ক্ষমতা মারবেই
বীর কলা মঞ্চ-কে ডেকেছিস কেন? তোরা কি নকশাল?’ আচমকা এ প্রশ্নে একটু চমকেই গিয়েছিলেন অজয়ন। পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের ছাত্র অজয়নদের ক্যাম্পাসে সে দিন, ২১ অগস্ট, মহারাষ্ট্রের কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনের নেতা, সদ্য খুন হয়ে যাওয়া ডাক্তার নরেন্দ্র দাভলকরের স্মরণে একটা অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানের দিনটা আগে থেকেই ঠিক ছিল। কিন্তু আগের দিন ভোরেই ভাড়াটে খুনিরা এসে দাভলকরের বুকে-মাথায় কয়েকটা বুলেট গুঁজে চলে যাওয়ার পরেও ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা কর্মসূচি বাতিল করেননি। তাঁদের মনে হয়েছিল, অন্ধ সংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে যে-ভাবে জীবনটাই দিয়ে দিলেন দাভলকর, তাঁদের এ দিনের সাংস্কৃতিক আয়োজনের বিষয়টির সঙ্গে তা খুব মিলে যায়। তাই শোক আর স্মরণের পাশাপাশি নিজেদের আর এক বার উদ্দীপ্ত করার এই হাতে-গরম সুযোগ তাঁরা ছাড়তে চাননি। তাই পুণে শহরে সে দিন বন্ধ-এর ডাক দেওয়া হলেও ইনস্টিটিউট-এ দেখানো হয়েছিল আনন্দ পটবর্ধনের তথ্যচিত্র ‘জয় ভীম কমরেড’। সেই সঙ্গে সরকারি বিধিনিষেধের আওতা থেকে আইনি মুক্তির পর কেকেএম, মানে কবীর কলা মঞ্চেরও এটাই ছিল প্রথম লাইভ অনুষ্ঠান।
শহিদ স্মরণ। নরেন্দ্র দাভলকরের হত্যার প্রতিবাদে মিছিল। পুণে, অগস্ট ২০১৩। ছবি: পি টি আই
সেই অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসার পরেই অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের ঝান্ডাওয়ালা কিছু ছেলে ঘেরাও করে ফেলে অজয়নকে। তার পরেই ওই প্রশ্ন! অজয়ন বলেন, তিনি কোনও দলের রাজনীতি করেন না। এবিভিপি-র ছেলেরা বলে তা হলে তুই জয় নরেন্দ্র মোদী বল! নকশাল না-হওয়ার প্রমাণ দে! বটেই তো। তুমি যদি লাল না হও, তোমায় গেরুয়া তো হতেই হবে! অজয়ন রাজি হননি। ফলে ঝান্ডার লাঠি-রড দিয়ে তাঁকে সিধে করার পুণ্যকর্ম শুরু হয়ে যায়। অজয়নের বন্ধুরাও ছুটে আসেন। এবং মার খান। এক জনকে হাসপাতালে ভর্তি করে মাথায় কয়েকটা সেলাইও দিতে হয়। ‘অপারেশন’ সেরে ফেরার পথে ঝান্ডাধারীরা পুলিশ ফাঁড়িতে ‘নকশালবাদী’ ছাত্রদের নামে পাল্টা হামলার নালিশ ঠুকে দিয়ে যায়।

এবিভিপি-র পুণে জেলার সভাপতি পরিষ্কার বলেছেন, তাঁদের আসল টার্গেট ছিল কেকেএম। ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা মাঝে পড়ে মার খেয়েছেন। কোল্যাটারাল ড্যামেজ! কিন্তু কেকেএম তাদের টার্গেট কেন? কারণ এরা ভগবান মানে না, ধর্ম মানে না, এবং নকশাল! নিহত নরেন্দ্র দাভলকরের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল: তিনি ঈশ্বর-বিরোধী, ধর্ম-বিরোধী, হিন্দু প্রথা-আচার-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির বিরোধী। (আর এ রকম বিপজ্জনক লোক নিশ্চয়ই মাওবাদী-টাওবাদী না-হয়ে যায় না!) নরেন্দ্র দাভলকরের তো তবু কপাল ভাল, রাজ্য সরকার তাঁকে জেলে পোরেনি। যদিও তাঁর ড্রাফট করা জাদু-টোনা বিরোধী বিল সাত-সাত বার মহারাষ্ট্র বিধানসভায় পেশ করা হলেও তা নিয়ে এক বারও আলোচনাই হয়নি! শেষ পর্যন্ত তিনি খুন হয়ে যাওয়ার পর রাজ্য সরকারের ঘুম ভেঙেছে। মহারাষ্ট্র ক্যাবিনেট দাভলকরেরই খসড়া করা ব্ল্যাক ম্যাজিক ও কুসংস্কার-বিরোধী অর্ডিন্যান্সটা পাশ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার কত দিনে অনুমোদন দেয় সেটাই দেখার। তার পর তো আইন!
ক্ষমতার রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরা নরেন্দ্র দাভলকর বা কেকেএম-দের বিশ্বাস করতে পারেন না। কারণ, ক্ষমতাও তো এক ধরনের কুসংস্কারই। টিকে থাকার জন্য তাকে কতগুলো মত বা বিশ্বাসের ওপর অন্ধের মতো বাজি ধরতেই হয়। সুতরাং, যে লোকটার প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের নামই হল ‘মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি’, তিনিও নিঃসন্দেহে সন্দেহজনক! নইলে তিনি খামখা মহর্ষি আশারাম বাপুর পিছনে লাগবেন কেন? এ বছর হোলির দিন আশারামজি তাঁর নাগপুরের আশ্রমে শিষ্য-শিষ্যাদের নিয়ে চুটিয়ে হোলি খেলবেন বলে নাগপুর পুরসভার কাছ থেকে ৫০ হাজার লিটার জলের ট্যাঙ্ক আনিয়েছিলেন। অর্ধেক মহারাষ্ট্র যখন খরায় পুড়ছে, তখন রং খেলতে এত জলের অপচয় নিয়ে আশারামজিকে বিঁধেছিলেন দাভলকর। তাঁকে কে বোঝাবে, যুক্তির যেমন উৎসব হয় না, তেমনি উৎসবেরও যুক্তি হয় না।
কিন্তু আশারাম বাপুজির মতো মহাত্মাকে পবিত্র হোলির দিনে ক’লিটার জল বেশি খরচ করার জন্য যা-নয়-তাই বলা! ধম্মে সইবে? মাথার ওপর ভগবান নেই? অবশ্যই আছেন। তিনি ‘রিঅ্যাক্ট’ও করেছেন। গত ২০ অগস্ট (হিন্দু) ধর্ম সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের অবমাননার দায়ে সোপর্দ ডাক্তার নরেন্দ্র দাভলকর ইতিমধ্যেই ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত’ হয়েছেন। অভিযোগের আঙুল উঠেছে হিন্দু সংগঠনগুলোর দিকে। দাভলকরের সঙ্গে বিজেপি বা শিবসেনার লড়াইটা হয়তো অনেক সরাসরি ছিল। কিন্তু সে লড়াইয়ে কংগ্রেসও দাভলকরের মিত্রপক্ষ ছিল না। তেমনই, এবিভিপি-র জঙ্গি কর্মীরা যেমন কেকেএম-এর শিল্পীদের উপর চড়াও হওয়ার জন্য ফিল্ম ইনস্টিটিউটের গেটের বাইরে ওত পেতে থাকে, তেমনই কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের অ্যান্টি-টেররিজম স্কোয়াড সক্রিয় হয়। তাদের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাওবাদী বলে তাদের সদস্যদের জেলে পোরা হয়।
মুশকিলটা সেই ক্ষমতার। ক্ষমতা বুঝতেই পারে না, কেন দাভলকরের মতো এক জন মানুষ ডাক্তারি পেশা শিকেয় তুলে, ঘরের খেয়ে সংস্কার আর কুযুক্তির বনবাদাড়ে যুক্তিবাদের মোষ চরাতে যাবেন! ক্ষমতা ধন্দে পড়ে যায়, কেন কলা মঞ্চের কমবয়েসি ছেলেমেয়েরা টিভি সিরিয়ালে না নেমে, রিয়েলিটি শো-এ না গিয়ে, নোংরা দলিত বস্তিতে, ঘিঞ্জি শ্রমিক মহল্লায় সমাজবদলের গান গেয়ে বেড়াবে? ক্ষমতা এ সবের ব্যাখ্যা করে, ক্ষেপে ওঠে এবং প্রত্যাঘাতে নামে। তা ছাড়া, এই দাভলকর কিংবা কেকেএম-এর শিল্পীরা মানুষের অনেক মেনে নেওয়াকে তর্ক-যুক্তি দিয়ে যাচাই করতে চেয়েছেন। অথচ ক্ষমতা, যে রঙেরই হোক, অনেক কিছুই আবডালে রাখতে চায়। ভক্তিভরে চোখ বুজে বিশ্বাস করাই নয়, যুক্তি উঁচিয়ে, গলা বাজিয়ে তর্ক করাটাও যে ভারতীয় ট্র্যাডিশন, সেটা ভুলিয়ে দিতে চায়।

ফিল্ম ইনস্টিটিউটে সে দিন প্রদর্শিত তথ্যচিত্রের ‘ভীম কমরেড’ আসলে ভীমরাও অম্বেডকর। মহারাষ্ট্র তথা গোটা ভারতের দলিত নিম্নবর্গের আন্দোলনের আইকন। গত আড়াই দশক ধরে ঘটে চলা ‘সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর প্রক্রিয়ায় পছন্দ করুন চাই না-করুন, তাঁকে উপেক্ষা করা ভারতের কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। তো, ১৯৯৭ সালে মুম্বইয়ের দলিত বস্তি রমাবাই কলোনির বাসিন্দারা সকালে উঠে দেখেন তাঁদের কলোনির মোড়ে অম্বেডকরের মূর্তির গলায় কে বা কারা জুতোর মালা ঝুলিয়ে গেছে। তাঁরা প্রতিবাদ করেন। তখন রাজ্যে শিবসেনা-বিজেপি সরকার। পুলিশের গুলিতে দশ জন দলিতের মৃত্যু হয়। এ ঘটনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন বামপন্থী দলিত কবি-গায়ক বিলাস ঘোঘরে।
আনন্দের ছবিটা এখান থেকেই শুরু হয়। চোদ্দো বছর ধরে তৈরি প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার ছবিটা আসলে একটা পরিক্রমা যেটা বার বার এবং শেষ পর্যন্ত ছবিটা বার বার এবং শেষ পর্যন্ত ওই কলোনিতেই ফিরে আসে। মাঝখানের সময়টায় বিলাস ঘোঘরে গান-কবিতায়, কেকেএমের ‘লাইভ’ অনুষ্ঠানের ফুটেজ থেকে তীব্র ভাবে একটাই সত্যি উঠে আসে। এ দেশের দলিত আন্দোলন আসলে সামাজিক পিলসুজের পা-দানিতে থাকা, তেলকালি মাখা মানুষের যুক্তিবুদ্ধির লড়াই। যে লড়াই উপরতলার চাপানো বানানো ন্যায় স্মৃতি শাস্ত্র পুরাণের রকমারি অন্যায় কুযুক্তি কুসংস্কার অন্ধত্বের অপমানকে বার বার চ্যালেঞ্জ করেছে।
ছবির শেষের দিকে আমরা দেখি, কংগ্রেস-বিজেপির মতো দলগুলো মহারাষ্ট্রের দলিত আন্দোলনকে দখল করে নিচ্ছে, অম্বেডকরকে রাজনীতির বাজারের পণ্য বানাচ্ছে। কিন্তু তার পরেও বিলাস ঘোঘরের কবিতায় ‘কুসংস্কারের জঙ্গল’ পুড়িয়ে দেওয়ার ডাকটা থেকেই যাচ্ছে। বিলাসের একদা কমরেড জয়ন্ত হিরের ছোট্ট দুটি মেয়ে যখন ওই রুমাবাই কলোনির খুপরি ঘরে বসেই গান ধরে ‘দেব নাহি, দেব নাহি’, আর সেই কচি গলায় ভূত-ভগবান-স্বর্গ-মর্ত্যকে উপেক্ষা করার প্রতিজ্ঞা, বস্তির গাদাগাদি-ঘেঁষাঘেঁষি টিনের চালার ছাদ পেরিয়ে আরও বড় আকাশের দিকে ভেসে যায়, তখন বুকের ভেতরটা শিরশির করবেই।
ছবি দেখতে আসা এ বি ভি পি-র সদস্যদেরও নিশ্চয়ই করেছিল। তারা বুঝতে পারছিল, নরেন্দ্র মোদীর ‘রাষ্ট্রবাদী’ হিন্দুত্বের ইমেজ-এর উল্টো দিকে কোথাও একটা যুক্তিবাদী, তার্কিক ভারতের মূর্তি খাড়া হয়ে থাকছে। সেখানে অম্বেডকর, দাভলকর, কে কে এম-এর শিল্পীরা সবাই হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে! কেন্দ্রীয় সরকারের টাকায় চলা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অন্দরে এ ধরনের সমাবেশ তারা সহ্য করবে কেন? ফলে যা ঘটার তা-ই ঘটেছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.