সত্যিই কি গত আড়াই বছর ধরে নিপীড়িত সিরিয়ার জনগণের জন্য বা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার
বন্ধের জন্য আমেরিকার এই পদক্ষেপ? ইতিহাস অন্য কথা বলে, অন্য সন্দেহ জাগায়।
নাজেস আফরোজ |
দামাস্কাস ছেড়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের রাসায়নিক অস্ত্র পরীক্ষকরা বেরিয়ে আসছেন, গত সপ্তাহে টেলিভিশনে এই ছবি দেখে অনেকেরই ২০০৩ সালে বাগদাদ থেকে অস্ত্র পরীক্ষকদের চলে আসার ছবি মনে পড়েছিল। তার কয়েক দিনের মধ্যেই ইরাকে আমেরিকার আক্রমণ শুরু হয়। সিরিয়াতে আমেরিকার নেতৃত্বে আর একটি ইরাক কাণ্ড হতে চলেছে, এমন আশঙ্কা মনে আসা অস্বাভাবিক নয়।
২০১১ সালের শুরু থেকেই সমগ্র আরব দুনিয়ায় একনায়কদের বিরুদ্ধে যখন গণ-আন্দোলনের জোয়ার ওঠে, তখন সিরিয়াতেও তার ঢেউ আছড়ে পড়ে। টিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরিনের অনুপ্রেরণায় সিরিয়ার জনগণ গণতন্ত্রের দাবিতে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আসাদ শুরু থেকেই নির্মম ভাবে এই আন্দোলনের মোকাবিলা করেন। কয়েক হাজার নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীর প্রাণ যায়। এর পরেই প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরোধীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেন এবং অচিরেই গণ-আন্দোলনটি পরিণত হয় একটি গৃহযুদ্ধে। আড়াই বছরের গৃহযুদ্ধে রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেবে দু’পক্ষের প্রায় এক লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই নিরস্ত্র, নিরীহ। পনেরো লক্ষ সিরিয়াবাসী বাস্তুহারা হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী দেশ তুরস্ক, জর্ডন ও লেবাননে। |
হোয়াইট হাউসের সামনে নাগরিকদের প্রতিবাদ। ওয়াশিংটন, ৩১ অগস্ট। ছবি: এ এফ পি |
দেড় সপ্তাহ আগে আসাদ-বিরোধীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আসে, দামাস্কাসের পূর্ব শহরতলিতে সরকারি বাহিনী রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে, যার ফলে কয়েকশো মানুষের প্রাণ গেছে। সংখ্যাটি এখন হাজার ছাড়িয়েছে। আসাদ আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি লঙ্ঘন করে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন, এই অভিযোগের ভিত্তিতে পশ্চিম দুনিয়া অতি দ্রুত রণদামামা বাজিয়ে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট আসাদ কখনওই এই দেশগুলির নয়নের মণি ছিলেন না, কিন্তু রাশিয়ার রাজনৈতিক সহযোগিতায় পুষ্ট, রুশ অস্ত্রে সজ্জিত সিরীয় বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা খুব সহজ ছিল না। আসাদ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন, এই অভিযোগ সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের একটা যুক্তি খাড়া করার সুযোগ এনে দিয়েছে। এই পশ্চিমী দেশগুলির নেতৃত্বে আমেরিকা। তার পুরনো অনুগামী ব্রিটেন। ফ্রান্স ইরাকের যুদ্ধে বিরোধিতা করলেও সিরিয়ার প্রশ্নে আমেরিকার সঙ্গে আছে।
রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা ছাড়াও উদ্বাস্তুদের দুর্দশা আর নিজের দেশের মানুষের উপর প্রেসিডেন্ট আসাদের বাহিনীর নির্মম আক্রমণের বর্ণনা বার বার উল্লেখ করা হচ্ছে আমেরিকার পক্ষ থেকে। এই সব যুক্তি দেখিয়ে বলা হচ্ছে, সিরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। ওয়াশিংটন এই দাবি নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব আনার চেষ্টা করলেও সেটি মূলত রাশিয়া আর অংশত চিনের বিরোধিতায় হালে পানি পায়নি। তাই আমেরিকা সচারচর যা করে থাকে, তাই করতে উদ্যত হয়েছে, অর্থাৎ তারা একক ভাবে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে বলে জানিয়েছে।
কিন্তু সত্যিই কি গত আড়াই বছর ধরে নিপীড়িত সিরিয়ার জনগণের জন্য বা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার বন্ধের জন্য আমেরিকার এই পদক্ষেপ? প্রথমে তাকানো যাক যুদ্ধক্ষেত্রে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টির দিকে। যুদ্ধক্ষেত্রে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার বন্ধ করতে ১৯২৫ সালে জিনিভায় যে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়, আমেরিকা সেটিকে বারে বারে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এসেছে তার সুবিধে মতো। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর আমেরিকার মদতে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন যখন ইরানের সঙ্গে দশ বছরর ধরে যুদ্ধ করেন, সেই সময় ইরানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সাদ্দাম বেশ কয়েক বার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। সি আই এ-র কিছু গোপন নথি গত সপ্তাহেই ‘ডিক্লাসিফায়েড’ হয়েছে, অর্থাৎ জনসমক্ষে এসেছে। তার থেকে জানা যাচ্ছে, ইরাক যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করতে যাচ্ছে তা তাদের জানা ছিল এবং তাতে তাদের পুরোপুরি সমর্থন ছিল।
এই গোপন নথির ১৯৮৪ সালের ২৩ মার্চের এক প্রতিবেদনে সি আই এ বলছে, ইরাক স্নায়ু গ্যাস ব্যবহার শুরু করেছে, এর ব্যবহার ইরানকে বিপাকে ফেলবে। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র নির্মাণ কারখানাগুলি ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য যথেষ্ট স্নায়ু গ্যাস উৎপাদন করতে সক্ষম। এই প্রতিবেদনের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অংশে বলা হচ্ছে যে, ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে ইরান একটি আন্তর্জাতিক মতামত সৃষ্টি করতে চাইলেও তাতে তারা খুব ‘সফল হবে না’। এই সাম্প্রতিক প্রকাশিত নথি এটাই প্রমাণ করে যে, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে আমেরিকার কোনও নীতিগত অবস্থান নেই। শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলে তারা শত্রুর শত্রুকে সেই অস্ত্র সরবরাহ করতেও রাজি থাকবে। সুতরাং সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যতই নীতির প্রশ্ন তুলুন না কেন, তাতে চিড়ে ভিজছে না।
এ বার প্রেসিডেন্ট আসাদের নিজের দেশবাসীকে হত্যা আর দেড় লক্ষ উদ্বাস্তুর দুর্দশা নিয়ে আমেরিকার উদ্বেগের দিকে নজর দেওয়া যাক। এই উদ্বেগকে সৎ বলে মেনে নেওয়া যায় কি? ১৯৫০-এর দশক থেকে পশ্চিম এশিয়া তথা আরব দুনিয়ায় আমেরিকার প্রকাশ্য আর গোপন হস্তক্ষেপের ফলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার ইতিহাস আজ গোটা বিশ্বের জানা। ওই অঞ্চলের ওপর নিজের রাজনৈতিক প্রভাব অটুট রাখা, ওই অঞ্চলের তেলের ভাণ্ডারের ওপর আমেরিকার তেল সংস্থাগুলির একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখা আর সেখানকার দেশগুলিতে মার্কিন অস্ত্র প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির রফতানি চালু রাখা, এই তিন উদ্দেশ্যে আমেরিকা একের পর এক দেশে স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করে এসেছে। সৌদি আরবের মতো একটি দেশের জনগণ প্রতিদিন যে বর্বর অত্যাচারের সম্মুখীন হন তা আসাদের নিপীড়নের থেকে কোনও অংশে কম নয়। এই সাম্প্রতিক আরব বিদ্রোহের সময় বাহরিনের শাসক, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের মতোই, নিজের দেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছেন। কিন্তু সেই শাসক শেখ যেহেতু তাদের বন্ধু সেহেতু আমেরিকার সেখান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে অসুবিধে হয়নি। তাই সিরিয়ার অত্যাচারিত জনগণের জন্য আমেরিকার ‘মানবিক’ উদ্বেগ যে কুম্ভীরাশ্রু, এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।
তা হলে কেন সিরিয়ার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ের প্রস্তুতি? সিরিয়ার তেল ভাণ্ডার নিয়ন্ত্রণে আনা একটা কারণ, কিন্তু বড় কারণ নয়, সিরিয়ার তেলের ভাণ্ডার খুব বেশি নয়। প্রেসিডেন্ট ওবামার ভাষণ মন দিয়ে শুনলে বোঝা যায়, কেন এই রণদামামা। সিরিয়া প্রসঙ্গে দুদিন আগেই তিনি বলেছেন, আমেরিকা নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে সামরিক পদক্ষেপ নেবে। আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি, সিরিয়া আমেরিকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। তা হলে?
আসলে পশ্চিম এশিয়ায় যে দেশটিকে নিয়ে আমেরিকার সব থেকে বড় উদ্বেগ, সেটি হল ইরান। আর আলাভি শিয়া নেতা আসাদের নেতৃত্বে সিরিয়া হল ইরানের তাঁবেদার দেশ, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’। ১৯৭৯’তে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই পশ্চিম এশিয়ায় ইরান আমেরিকার পক্ষে কণ্টকস্বরূপ। ইরানের সঙ্গে সিরিয়ার বিস্তৃত সীমানা রয়েছে। আসাদকে হটিয়ে সেখানে যদি নিজেদের তাঁবেদার কোনও সরকার গঠন করা যায়, তা হলে ইরানকে সামরিক ভাবে ঘিরে ফেলা যায়। ওই অঞ্চলের ইতিহাস আর আমেরিকার কার্যাবলি থেকে এমন একটা কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, সিরিয়া নয়, ইরানই আমেরিকার আসল লক্ষ্য। |