সাম্রাজ্যবাদকে ঘৃণা জানাইয়া দশ কিলোমিটার ইহাই ছিল সিপিআইএমের মুখপত্রে রবিবারের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ‘মহামিছিল’-এর চরিত্র। হঠাৎ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই কামান-গর্জন কেন? কারণ সুদূর পশ্চিম এশিয়ার সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকি আগ্রাসনের ছক কষিতেছে। বিষয়টি কিঞ্চিৎ দূরবর্তী মনে হইতেছে? কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক বা অবান্তরও? মনে হইলে তাহা সাম্রাজ্যবাদের সমর্থন ভিন্ন কিছু নহে। সি পি আই এম তথা বামপন্থীরা মনে করেন, এই মুহূর্তে আন্দোলিত হওয়ার মতো কোনও বিষয় এই রাজ্যে কিংবা দেশে নাই। থাকিলেও তাহা সিরিয়ায় সম্ভাব্য মার্কিন হানাদারির তুলনায় অকিঞ্চিৎকর। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিমান বসুর হুঁশিয়ারি, শেষ পর্যন্ত যদি দামাস্কাসে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র আছড়াইয়া পড়ে, তাঁহারা কিন্তু কলিকাতা অচল করিয়া দিবেন! আশা করা যায় এই হুমকির ভয়েই সাম্রাজ্যবাদী অপপ্রয়াস ভয়ে কুঁকড়াইয়া যাইবে!
সি পি আই এম ও বামেরা যে এই প্রথম এমন অস্তিত্ব জাহিরের প্রচেষ্টায় মাতিয়াছেন, এমন নহে। দেশের, রাজ্যের, পাড়া-প্রতিবেশীর আশু সমস্যার প্রতি চর্চিত ঔদাসীন্যের বিপরীতে তাঁহারা বরাবরই রকমারি আন্তর্জাতিক বিষয় লইয়া ভাবিত, আন্দোলিত হইয়াছেন (গত শতাব্দীর ষাটের দশকের ভিয়েতনাম-ভাবাবেগ স্মর্তব্য)। চিনের কমিউনিস্ট পার্টি সাম্যবাদী আদর্শ হইতে কতটা বিচ্যুত হইয়াছে, ফিদেল কাস্ত্রোর উত্তরসূরিরা কিউবাকে ধনতন্ত্রের পথে টানিয়া লইতেছে কি না, ভেনেজুয়েলায় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যসংখ্যা কেন হ্রাস পাইতেছে, ইত্যাদি প্রশ্নে এ দেশের বাম নেতৃত্বকে ভয়ানক উদ্বিগ্ন দেখা যায়। ভারতীয় বামপন্থীরা আজও স্বদেশের স্বাধীনতা দিবসে দলীয় স্তরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন না, কিন্তু পয়লা মে’র আন্তর্জাতিক শ্রমদিবসে, লেনিনের জন্মদিনে কিংবা বলশেভিক বিপ্লবের বার্ষিকীতে নিয়মিত তাঁহাদের দলীয় দফতরে রক্তপতাকা সগৌরব উড়িয়া থাকে। স্বভাবতই এই পোড়া বঙ্গদেশের সমস্যা তাঁহাদের হৃদয় বা মস্তিষ্ককে তত স্পর্শ করে না। নহিলে এমন তো নয় যে পশ্চিমবঙ্গে কিংবা ভারতে আন্দোলন করার মতো বিষয় কম পড়িয়াছে। গোটা দেশের কথা ছাড়িয়া দিলেও এই রাজ্যে নৈরাজ্য ও দুর্বৃত্তায়ন, পঞ্চায়েত নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংকীর্ণ দলবাজি, মহিলাদের বিরুদ্ধে বর্ধমান অপরাধপ্রবণতায় পুলিশি তৎপরতার অভাব, ভ্রান্ত জমি-নীতির কারণে শিল্পায়নে রাজ্যের ক্রমিক অনগ্রসরতা, গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনজনিত সঙ্কট বিষয়ের তো কোনও অভাব নাই।
রাজ্যবাসী এ সমস্ত বিষয়ে যতই উৎপীড়িত উদ্ব্যস্ত বোধ করুন না কেন, বামপন্থীরা রাজ্যের বিরোধী দল হইয়াও এই সবের বিরুদ্ধে কোনও অর্থপূর্ণ আন্দোলন সংগঠিত করিতে পারেন নাই। বিধানসভার ভিতরে কিংবা বাহিরে, কোথাও তাঁহাদের কোনও প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ দেখা যাইতেছে না। গত আড়াই বৎসরে বহু রাজনৈতিক সুযোগক্ষণ হেলায় হারাইয়া শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ দূরবর্তী একটি বিষয়ে মিছিল বাহির করিয়া বাম নেতারা আপাতত আত্মশ্লাঘায় পূর্ণ। ইহাতে এক হিসাবে শাসকরাই নিশ্চিন্ত ও নিরুপদ্রব বোধ করিতেছেন। সি পি আই এমের মতো ‘বিরোধী পক্ষ’ থাকিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আর মিত্র অন্বেষণ করিতে হইবে না। তাঁহার রাজ্যপাট সম্পূর্ণ নির্বিঘ্ন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বাস্তবটি বিপজ্জনক। কিন্তু তাহার কথা কে ভাবিতেছে? |