জেলবন্দি এক পুলিশকর্তার লেখা দশ পাতার একটা দীর্ঘ পদত্যাগপত্র। আর তার ধাক্কাতেই রীতিমতো বেসামাল নরেন্দ্র মোদী। বেকায়দায় তাঁর দল বিজেপিও। উল্টোদিকে বিজেপির সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর বিরুদ্ধে বাড়তি অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে তুমুল উল্লাস কংগ্রেসের অন্দরমহলে।
সোহরাবউদ্দিন, তুলসীরাম প্রজাপতি-সহ চারটি ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত ডি জি বানজারা গুজরাত পুলিশের প্রাক্তন ডিআইজি। ২০০৭ থেকেই সাবরমতী জেলে বন্দি এবং চাকরি থেকে সাসপেন্ড হয়ে রয়েছেন। এ বার জেল থেকেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি। দশ পাতার সেই চিঠিতে নিজের ইস্তফার কথা জানানোর পাশাপাশি তিনি যা লিখেছেন, তাতেই সরগরম রাজনীতির ময়দান।
চিঠিতে বানজারা লিখেছেন, “নরেন্দ্র মোদীর প্রতি শ্রদ্ধার কারণে এত দিন নীরব ছিলাম। কারণ ওঁকে ভগবান বলে মানতাম। এখন দেখছি দিল্লি যাত্রার জন্য ওঁর এত তাড়া যে, জেলবন্দি পুলিশ অফিসারদের প্রতি ঋণ শোধ করতেই ভুলে গিয়েছেন! অথচ এই অফিসারদের জন্যই
তিনি সাহসী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।”
এখানেই শেষ নয়। মোদীর অন্যতম আস্থাভাজন তথা রাজ্যের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অমিত শাহ-র বিরুদ্ধেও তীব্র বিষোদ্গার করেছেন বানজারা। এই পুলিশ কর্তার বক্তব্য, অমিত শাহের ‘কুপ্রভাবেই’ তাঁর ‘ঈশ্বর’ বিপথে চালিত হয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, “আমাকে এবং আমার অফিসারদের জেলে আটকে রেখে সিবিআই-এর হাত থেকে নিজেদের চামড়া বাঁচাতে এবং রাজনৈতিক ফায়দা লুঠতেই ব্যস্ত এই সরকার।” সেই সঙ্গেই মোদী-সরকারের দিকে তোপ দেগে বানজারার অভিযোগ, ১২ বছর ধরে বিভিন্ন সংঘর্ষ মামলার কথা তুলে ধরে মোদীর সরকার বিপুল রাজনৈতিক ফায়দা তুললেও জেলে বন্দি পুলিশ অফিসারদের কথা ভাবেইনি।
একের পর এক অভিযোগে গুজরাত সরকারকে তুলোধোনা করে বানজারা শুধু যে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতৃত্বকেই চরম অস্বস্তিতে ফেলেছেন তা নয়, তাঁর চিঠির একটি অনুচ্ছেদ ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় মোদীর বিরুদ্ধে মারাত্মক অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজেপিরই অনেকে। ওই অনুচ্ছেদে বানজারা লিখেছেন, “স্পষ্ট করে জানাতে চাই, যা করেছি, তা রাজ্য সরকারের গৃহীত সুচিন্তিত নীতি মেনেই।” দলের অনেকেই মনে করছেন, ওই অংশটির অর্থ হল, ভুয়ো সংঘর্ষের ঘটনায় এখন মোদীকেও জড়াতে চাইছেন বানজারা। কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভিরও বক্তব্য, বানজারার ওই চিঠিকে নথি হিসেবে গণ্য করে ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় মোদীকে জড়ানোর দাবি উঠতে পারে।
পদত্যাগপত্রটি গুজরাতের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি ও আইজি-কে দেওয়ার পাশাপাশি বানজারা পাঠিয়েছেন সিবিআইয়ের প্রধানকেও। আর তাতেই আশঙ্কার মেঘ জমছে বিজেপির অন্দরে। কী বলা যায় একে? অস্বস্তির ত্র্যহস্পর্শ?
ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় অমিত শাহকে বাঁচাতে অভিযোগকারীকে প্রভাবিত করার অভিযোগে গত কালই সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে বিজেপির দুই নেতার বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে একটি ‘স্টিং অপারেশন’-এর ভিডিও এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যেই আজ মোদী সরকারের লোকায়ুক্ত বিল ‘অপর্যাপ্ত’ বলে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন রাজ্যপাল কমলা বেনিওয়াল। এই দুই ঘটনা নিয়ে এমনিতেই উত্তপ্ত রাজনীতির তাপ আজ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বানজারার পত্রবোমা।
একের পর এক ঘটনায় মোদী তথা বিজেপির চরম অস্বস্তিতে প্রত্যাশিত ভাবেই উচ্ছ্বসিত কংগ্রেস। মাত্র ক’দিন আগে রাহুল গাঁধী দলের মুখপাত্রদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, মোদীর বিরুদ্ধে মন্তব্য না করতে। মোদীকে আক্রমণ করলে মেরুকরণের রাজনীতিতে হাওয়া লাগতে পারে, এই আশঙ্কাতেই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আজ তাঁরই সবুজ সঙ্কেত পেয়ে কংগ্রেসের সদর দফতর থেকে মোদীর বিরুদ্ধে সুর চড়ানো হয়েছে। তুলসীরাম প্রজাপতি ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় মোদীর পদত্যাগও দাবি করেছে কংগ্রেস।
বানজারার চিঠি মনোবল বাড়িয়েছে বিজেপির অন্দরে মোদী-বিরোধীদেরও। মোদীকে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করার জন্য যখন বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের বড় অংশ সক্রিয়, ঠিক তখনই এমন ঘটনায় বেশ উজ্জীবিত দলের মোদী-বিরোধী অংশ। মোদী-ঘনিষ্ঠরা অবশ্য গোটা ঘটনাকে কংগ্রেসের চক্রান্ত বলে দাবি করছেন।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, কংগ্রেস কিন্তু বানজারার চিঠি সম্পর্কে কিছু বলতে নারাজ। কংগ্রেস নেতৃত্বের বক্তব্য, বানজারা নিজেই ভুয়ো সংঘর্ষে অভিযুক্ত। তা ছাড়া তিনি মোদীর তৈরি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। ভোটের মুখে জেল থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মোদীকে ব্ল্যাকমেল করতেই তিনি এমন চিঠি লিখেছেন বলে দাবি কংগ্রেসের ওই নেতাদের। তাঁদের বক্তব্য, ওই চিঠির দৌলতে দলের কিছুটা ফায়দা হলেও বানজারাকে সমর্থন জানালে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে উস্কানির অভিযোগ উঠতে পারে। তা কংগ্রেসের অস্বস্তি বাড়াবে।
এই অবস্থায় কংগ্রেস অস্ত্র করতে চাইছে বিজেপি-র দুই নেতা প্রকাশ জাভড়েকর ও রাজ্যসভার সাংসদ ভূপেন্দ্র যাদবের বিরুদ্ধে ‘স্টিং অপারেশন’কে। ওই ভিডিও ফুটেজকে সামনে রেখে সুপ্রিম কোর্টে যে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে, তার মোদ্দা বক্তব্য, সোহরাবউদ্দিন মামলায় অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী তথা ভুয়ো সংঘর্ষে নিহত তুলসীরাম প্রজাপতির মা নর্মদাকে ভুল তথ্য দিয়ে ৬টি ফাঁকা ওকালতনামায় সই করিয়ে নিয়েছিলেন জাভড়েকর ও যাদব। তাঁদের উদ্দেশ্য একটাই, অমিত শাহকে বাঁচানো। কংগ্রেসের বক্তব্য, এই ষড়যন্ত্রের কথা নরেন্দ্র মোদীও জানতেন। তাই নিরপেক্ষ তদন্তে তিনি বাধা দিচ্ছেন। মোদী মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকলে তদন্ত সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত সিডি-কাণ্ড নিয়ে গতকাল মুখ খোলেননি জাভড়েকর। আজ তিনি বলেন, “ওই সিডি কংগ্রেসের সাজানো।” |