লাগামছাড়া মাফিয়ারাজ নৌকায় জেনারেটর বসিয়ে
শুষে নেওয়া হচ্ছে বালি
লকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ রয়েছে। রয়েছে হাইকোর্ট নিযুক্ত কমিটির নির্দেশিকাও। কিন্তু, সে সবে থোড়াই কেয়ার! গঙ্গার বুকে মেশিন বসিয়ে অবাধে চলছে সাদা বালি তোলার কারবার। প্রশাসন সব জানে। জেনেও চুপ থাকে অভিযোগ পাড় লাগোয়া বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীদের। উত্তরপাড়া থেকে কোন্নগর, রিষড়া, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটি, চন্দননগর, চুঁচুড়া থেকে ঈশ্বরগুপ্ত সেতু হয়ে বলাগড় পর্যন্ত অবাধে চলছে এই সাদা বালি তোলা।
নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, লাগামহীন অত্যাচারের জন্য গঙ্গার দু’তীরের নতুন নতুন এলাকায় ভাঙন বেড়ে চলেছে। গত কয়েক দশক জুড়ে গঙ্গার নাব্যতাও কমছে। তার ফলে গঙ্গায় নতুন নতুন এলাকায় চর পড়ছে। এক সময় সাদা বালির ততটা কদর ছিল না বাজারে। কিন্তু, এখন সাদা বালির ব্যবহার বাড়ছে। ফলে বাজার মূল্য বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এই বাজার ধরতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে বেআইনি বালির কারবারিরা। পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, বাম আমলে রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় অবাধে গঙ্গা থেকে বালি তোলা হত। রাজ্যে পালাবদলের পরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মূলত দু’টি উপায়ে গঙ্গা থেকে সাদা বালি তোলা হচ্ছে। প্রথমত, বড় নৌকা সরাসরি চরায় চলে যায়। গঙ্গায় ভাটার সময় কোদালে বালি কেটে নৌকায় তোলা হয়। বেশি রাত ও ভোরের দিকে চোরাগোপ্তা এই কারবার চলে। এখন অবশ্য গঙ্গার বুক থেকে সাদা বালি তোলার প্রযুক্তি আমূল বদলেছে। এই ব্যবসায় মুনাফা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঁচা টাকা লাগানোও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। বহু জায়গাতেই এখন আর লোক লাগিয়ে হাত কোদালে করে বালি তোলা হয় না। এখন লোহার নৌকায় জেনারেটর বসিয়ে গঙ্গার চরায় মেশিন লাগিয়ে ‘সাকশান’ পদ্ধতিতে তোলা হচ্ছে বালি। হুগলি জেলার সদর চুঁচুড়ায় মহসিন কলেজ লাগোয়া ঘাটে রীতিমতো অফিস ফেঁদে গঙ্গা থেকে বালি তোলা দীর্ঘদিন ধরেই চালু। সেই অফিসেই জেনারেটর রাখা। প্রশাসন সূত্রের খবর, উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়া এবং চুঁচুড়ার দুই বালি কারবারি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তৎকালীন (বাম পরিচালিত) জেলা পরিষদের থেকে একটি অনুমতিপত্র সংগ্রহ করেছিল। সেটাকেই ঢাল করে রমরম করে চলছে এই কারবার।
নৌকার সাহায্যে ভাটপাড়ায় গঙ্গা থেকে তোলা হচ্ছে বালি। সঙ্গে রয়েছে
‘সাকশন পাইপ’ও। পাড়ে অপেক্ষায় সারি সারি ট্রাক। ছবি: তাপস ঘোষ।
এই বেআইনি কারবারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে পরিবেশ কর্মীরাই এখন পদে পদে বালি মাফিয়াদের হুমকি আর বাধার মুখে পড়ছেন বলে অভিযোগ। বস্তুত, নিময়ভাঙার এই রীতির প্রতিবাদে কিছু গণ সংগঠন কাজ করে চলেছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে। ‘দিশা’ নামে তেমনই এক সংস্থার সম্পাদক শশাঙ্ক দেবের কথায়, “রাজ্যের নদী বা সমুদ্র থেকে বেআইনি বালি তোলা ঠেকাতে সরকার কোনও উদ্যোগী হয়নি। মানুষের সচেতনতা বাড়াতে পরিকল্পনাভিত্তিক প্রচার দরকার। সেই কাজে পুরসভা বা পঞ্চায়েতকে কাজে লাগাতে হবে।” তাঁর প্রশ্ন,“এই নিয়ে কতটুকু কাজই বা হয়েছে? তার ফলে উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে সমস্যা প্রতিদিন বাড়ছে।” সবুজের অভিযান ও পরিবেশ অ্যাকাডেমির ব্যবস্থাপনায় সম্প্রতি চন্দননগরে গঙ্গায় ভাঙন ঠেকাতে সভা হয়। নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বা পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, গঙ্গার উপর বেড়ে চলা অত্যাচারের জন্যই ভাঙনের সমস্যা বাড়ছে। এই অত্যাচারের অন্যতম দিক হল গঙ্গার বুক চিরে যথেচ্ছ বালি তোলা।
পরিবেশকর্মীদের মতে, সময় যত গড়াচ্ছে, পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, “২০০২ সালের ‘মাইনর মিনারেলস অ্যাক্ট’কে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আরও কঠোর ভাবে প্রয়োগ করতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বাম আমলে কিছুই হয়নি। আমাদের আইনে জেল এবং জরিমানার ব্যবস্থা থাকবে। এই বিষয়ে একমাত্র বিশেষজ্ঞ নির্দেশিত গাইড লাইন মেনেই কাজ করা হবে।”
সেচমন্ত্রী যতই আশ্বস্ত করুন, ঘটনা হল, এই আমলেও পরিস্থিতির বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। দিনের আলোয় সবার চোখের সামনেই গঙ্গা থেকে সাদা বালি তোলার কারবার চলছে। শাসকদলের এক শ্রেণির নেতা-কর্মী এবং গঙ্গা তীরবর্তী কিছু পুরসভার একাধিক কাউন্সিলরও এই কারবারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত বলে অভিযোগ। পরিবেশকর্মীদের মতে, এই সংগঠিত মাফিয়ারাজের কাছে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি বা সংস্থাগুলির সামর্থ্য নগণ্য। উল্টে প্রতিবাদ করার ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ, পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে আঁতাঁতেই এই কারবার চলে।
সেই আক্ষেপই শোনা যাচ্ছে চন্দননগরের পরিবেশ সংক্রান্ত আইনি সহায়তা কেন্দ্রের কর্ণধার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কথায়। তিনি বলেন, “গঙ্গার দু’পারে বালি তোলা রাজনৈতিক মদত ছাড়া সম্ভব নয়। বাম-ডান সব আমলেই এটা হচ্ছে। রাজ্যের ১১টি জেলার জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারকে এই বিষয়ে সর্তক করে চিঠি লিখেছি। জানিয়েছি মুখ্যসচিবকে। উত্তরপ্রদেশে একটা বাচ্চা মেয়ের (দুর্গাশক্তি নাগপাল) সাহস হল, আর এ রাজ্যের নেতা-আমলারা কি সব জেগে ঘুমোচ্ছেন?”

পুরনো খবর



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.