লাগামছাড়া মাফিয়ারাজ
সামান্য টাকাতেই মেলে মাটি কাটার ‘অনুমতি’
খেয়া বন্ধ রাত ১০টায়। তার পরে সুনসান ভাগীরথী। পাড়ে নৌকা বেঁধে বাড়ির পথে পা বাড়ান মাঝিও। কিন্তু মাঝরাতেই আবার জেগে ওঠে নদী। শোনা যায় ভুটভুটির শব্দ। ঝুড়ি, কোদাল হাতে পাড়ে নামে এক দল লোক। পাড়ের মাটি কেটে ঝুড়িতে করে নৌকায় বোঝাই করে আবার মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।
বর্ধমানের কালনা ও পূর্বস্থলীতে ভাগীরথীর আশপাশে মাটি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য দীর্ঘদিনের। ক্রমাগত পাড় কেটে নেওয়ার ফলে কালনার কালীনগর, নতুনচর, কলডাঙা-সহ নানা গ্রামে নদীর ভাঙন ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে। বেআইনি মাটি ব্যবসার হাত থেকে বাদ যাচ্ছে না চাষের জমিও। তাদের বাধা দেওয়ার সাহস পান না এলাকার বাসিন্দারা। অনেকে আবার সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে মাটি কারবারিদের জমি থেকে মাটি তোলার মৌখিক অনুমতি দিয়ে দেন। তবু কিছু আয় তো হল, এ কথা ভেবেই সান্ত্বনা পান তাঁরা। পূর্বস্থলীর বহড়া, শিমূলডাঙা, বেলেরহল্ট, দফরপোতা, তামাঘাটা, দেবনগর চরেও বালি তুলে নদীর পাড় সাফ করে দিচ্ছে দুষ্কৃতীরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাতের অন্ধকারে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার কাজে যুক্ত লোকজনের বেশির ভাগই বহিরাগত। তারা ভাগীরথীর উল্টো পাড়ে নদিয়ার দিক থেকে আসে। সাধারণত দু’ধরনের নৌকা ব্যবহার করে এই মাটি মাফিয়ারা। ছোট নৌকাগুলিতে ২০০ ঘনফুট মাটি ধরে। তাতে সাত-আট জন লোক প্রয়োজন হয়। বড় নৌকায় ধরে ৪০০ ঘনফুট মাটি। সেই নৌকায় মাটি কেটে নিয়ে যেতে লোক লাগে ১৩-১৪ জন।
কালনায় ভাগীরথী লাগোয়া জমি থেকে এ ভাবেই মাটি কাটা হয়।—ফাইল চিত্র।
কালীনগর, নতুনচর ইত্যাদি গ্রামে ভাগীরথী লাগোয়া খেতজমিতে বছরভর লঙ্কা, উচ্ছে, পটল-সহ নানা সব্জি চাষ করেন বাসিন্দারা। সেই সব সব্জি নৌকায় করে অন্য পাড়ে নিয়ে গিয়ে পাইকারি বাজারে বিক্রি করেই সংসার চলে তাঁদের। ওই চাষিদের দাবি, তিন গ্রামেই ক্রমে কমে আসছে চাষযোগ্য জমি। তার মূল কারণ, ভাগীরথীর পাড়ে লাগাতার মাটি কেটে নেওয়া। গ্রামগুলিতে নদীর ভাঙন মারাত্মক আকার নিয়েছে পাড় থেকে মাটি চুরির জন্যই। নতুনচরের বাসিন্দা আসান আলির মতে, তলার দিকের মাটি কেটে নেওয়ার ফলে ভাগীরথীর জলোচ্ছ্বাস সহ্য করতে পারে না উপরিভাগের পাড়। ফলে, বড় ফাটল তৈরি হয়ে তা ধসে যাচ্ছে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে চলা এই বেআইনি মাটি ও বালির কারবার নিয়ে মুখ খুলতে চান না এলাকার বেশির ভাগ মানুষই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক জন জানান, মূলত দু’ভাবে চলে এই কারবার। এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটি কাটার জন্য ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের কাছে আগাম রয়্যালটি জমা দিয়ে ব্যবসা করেন। এ ক্ষেত্রে পতিত জমি থেকে মাটি ও বালি তোলার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু যতটুকুর জন্য অনুমতি দেওয়া হয়, কার্যক্ষেত্রে তার বেশি এলাকা থেকেই মাটি কেটে নেয় ব্যবসায়ীরা। অন্য আর এক শ্রেণি অবশ্য কোনও অনুমতির পরোয়াই করে না। ইচ্ছে মতো মাটি কেটে ব্যবসা চালায় তারা।
ভাগীরথীর পাড় থেকে লাগাতার মাটি কাটা হলেও এলাকার মানুষজন বাধা দেন না কেন? উত্তর খুঁজতে গিয়ে উঠে আসে দু’টি বিষয়। প্রথমত, জমির মাটি দুষ্কৃতীরা কেটে নিয়ে যেতে পারে বা ভাঙনে জমি হারিয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কা করে অনেকে নিজের জায়গা থেকে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে ব্যবসায়ীদের মাটি কাটার অনুমতি দিয়ে দেন চাষিরাই। দ্বিতীয়ত, বর্ষায় যে সব জায়গায় জল জমে, সেখান থেকে জল সরে যাওয়ার পরে বালির আস্তরণ পড়ে। ফলে, চাষের অযোগ্য হয়ে যায় সেই জমি। বালি কেটে নিলে জমি আগের অবস্থায় ফিরে আসবে, এই আশায় দুষ্কৃতীদের বাধা দিতে চান না অনেক চাষি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ভরা বর্ষায় মাটি-বালি চুরির কারবার বন্ধ থাকে। সাধারণ মাটির তুলনায় পলিমিশ্রিত ভাগীরথীর পাড়ের মাটির দর বেশি। সাধারণ মাটি যেখানে ট্রাক্টর প্রতি ৪০০-৫০০ টাকা, সেখানে পাড়ের বালিমাটি বিক্রি হয় ৭০০-৮০০ টাকায়। তবে স্থানীয় ইটভাটাগুলির চাহিদা অনুযায়ী এই দর ওঠানামা করে।
কালনা মহকুমার পূর্বস্থলী ২ ব্লকেও রমরমা বালির কারবারের। ভাগীরথীর গা ঘেঁষা নানা জায়গায় দুষ্কৃতীরা এই কারবার চালায় বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। প্রতিটি দুষ্কৃতী দলের বালি কাটার জন্য এলাকা নির্দিষ্ট রয়েছে। মাঝে-মধ্যে এলাকা দখল নিয়ে তাদের গোষ্ঠী-সংঘর্ষও বাধে। সে কারণে দুষ্কৃতীরা চোরা পথে প্রচুর বেআইনি অস্ত্রও সংগ্রহ করে থাকে। পূর্বস্থলী থানার এক আধিকারিকের কথায়, “অল্প পরিশ্রম করেই অনেক বেশি টাকা রোজগারের হাতছানি রয়েছে এই বালি-মাটির ব্যবসায়। তাই অপরাধ জগতের একটি বড় অংশ এর সঙ্গে যুক্ত।”
রাজ্যের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথ পূর্বস্থলীরই বাসিন্দা। কালনা মহকুমায় মাটি ও বালির বেআইনি কারবারের অভিযোগ তাঁর অজানা নয়। তিনি জানান, ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
(চলবে)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.