লাগামছাড়া মাফিয়ারাজ
অভিযান শুরু হতেই রাজস্ব বাড়ল ১১ কোটি
ভাগ্যিস বাঁধটা ভেঙেছিল! না হলে তদন্ত হত না। আর তদন্ত না হলে জানাই যেত না, বছরের পর বছর ধরে কী ভাবে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চলছিল বেআইনি বালি আদায়।
মেদিনীপুর শহর লাগোয়া কংসাবতী নদীর উপরে দীর্ঘদিন ধরে ছিল ব্রিটিশ আমলে তৈরি একটি বাঁধ (অ্যানিকেট)। প্রশাসনিক উদাসীনতার সুযোগে সেই বাঁধ সংলগ্ন নদীর বুক থেকে অবৈধ বালি তোলার কারবারও দীর্ঘদিনের। প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এমনকী বালি তোলার কাজে ব্যবহার হচ্ছে বড় বড় যন্ত্রও। বস্তুত, কাঁসাই নদীর সেতুতে দাঁড়ালে যে কারও চোখে পড়বে, নদীর চরে দাঁড়িয়ে সার সার লরি-ট্রাক-ট্রাক্টর। নীরবে সেই লরি-ট্রাক-ট্রাক্টরে চলছে বালি তোলার কাজ।
বছরের পর বছর ধরে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে বালি তোলার ফলে একটা সময় নদীর ভিতরে তৈরি হয় বড় বড় গর্ত। আর সেই গর্তে পড়ে মৃত্যুও হয়েছে সাধারণ মানুষের। কাঁসাই লাগোয়া মেদিনীপুর শহরের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলর সৌমেন খান বলেন, “বেআইনিভাবে বালি তোলা এতটাই বেড়েছে যে, নদীর পাড় ভাঙতে ভাঙতে এ বার বাড়ি ভেঙে পড়ার অবস্থা। এলাকার চার জন গর্তে বালি চাপা পড়ে মারাও গিয়েছেন।” নদীর চর এ ভাবে ফোঁপরা হতে থাকায় বছর ছয়েক আগে ভেঙে পড়ে কাঁসাইয়ের ওই প্রাচীন বাঁধ। ফলে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সাতটি ব্লকে চাষের সেচের জল পাওয়া কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। মেদিনীপুর ও খড়্গপুর শহরে পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দেওয়ার অবস্থাও তৈরি হয়। শহরে জল সরবরাহের জন্য পাম্পসেট জলের তলায় তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। শুরু হয় তুমুল হইচই। নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় প্রশাসন। শুরু হয় তদন্ত। তার জেরে বেআইনি বালি বোঝাই লরি-ট্রাক ধরার অভিযান জোর পায়। হু হু করে বাড়তে থাকে জরিমানা।

এ ভাবেই কংসাবতী থেকে বালি তোলা হয়। —ফাইল চিত্র।
এতে আবার অন্য সঙ্কট দেখা দেয়। বেআইনি ধরপাকড়ের ফলে একটা সময় বালি তোলা তলানিতে ঠেকে। বিভিন্ন নির্মাণকাজ ব্যাহত হতে শুরু করে। তখন, জেলা প্রশাসন স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি লিজে বালি তোলার অনুমতি দেওয়া চালু করে। বর্তমানে জেলায় এ রকম দীর্ঘমেয়াদি লিজের সংখ্যা ৩৩ টি। যার মধ্যে কাঁসাই নদীতেই রয়েছে ২২টি (ধেড়ুয়া থেকে ডেবরা পর্যন্ত)। লিজ দেওয়ার পাশাপাশি চলতে থাকে জরিমানা আদায়। এই দু’য়ের জেরে হু হু করে বাড়তে থাকে রাজস্ব।
কতটা?
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ২০১০-১১ আর্থিক বছরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন ক্ষুদ্র খনিজে রাজস্ব আদায় করেছিল ৯ কোটি ১১ লক্ষ ৬৭ হাজার ২৫৮ টাকা। ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে ওই খাতেই রাজস্ব আদায় হল ২০ কোটি ১৯ লক্ষ ৯১ হাজার ২৫৮ টাকা। অর্থাত্‌, কাঁসাইয়ের বাঁধ ভাঙার সৌজন্যে হওয়া বেআইনি বালি বোঝাই গাড়ি ধরার অভিযানের ফলে এক বছর পরেই রাজস্বের বৃদ্ধি হয়েছে ১১ কোটি ৮ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা!
এই পরিসংখ্যানই জানান দিচ্ছে, বালি মাফিয়ারা কী ভাবে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক পদস্থ কর্তার স্বীকারোক্তি, “কর্মী সংখ্যা হাতে গোনা। তাঁদের মধ্যেও আবার অনেকের সঙ্গে ওই অসাধু বালি কারবারিদের আঁতাঁত রয়েছে। তল্লাশিতে যাওয়ার আগেই খবর পৌঁছে যায়। ফলে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি তো থাকেই।”
জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক অরিন্দম দত্তের অবশ্য দাবি, “এখন অবৈধ বালি তোলা অনেকটাই কমেছে। ফলে রাজস্বও বেড়েছে। অবৈধ চক্রগুলির কাজকর্ম সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করতেও কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছে।” মেদিনীপুরের তৃণমূল বিধায়ক মৃগেন মাইতিও বলেন, “অবৈধ ভাবে বালি তোলা দীর্ঘদিনের সমস্যা। শুধু রাজস্ব ক্ষতি নয়, মেদিনীপুর শহরে পানীয় জলের সঙ্কট বা কিছু ব্লকে সেচের সঙ্কটও এই অবৈধ কারবারের ফলে দেখা দিয়েছে হয়েছে। তবে, আগের থেকে প্রশাসন অনেক তত্‌পর হয়েছে। আমরাও বলেছি, কড়া হতে বেআইনি কারবার বন্ধ করতে হবে।”
ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, যদি দফতর সক্রিয় হয়ে রাজস্ব আদায় শুরু করে তাহলে বছরে এই দফতর কেবলমাত্র পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা থেকেই ১০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে পারবে। বর্তমানে জমির খাজনা, ক্ষুদ্র খনিজ-সহ নানা দিক থেকে বড়জোর ৩০-৩৫ কোটি (রাজ্য না জেলা) টাকা ওঠে। দফতরের কর্তাদের মতে, রাজস্ব আদায় আরও বাড়বে চেকপোস্ট তৈরি করতে পারলে। কারণ, নদীর বুক থেকে কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাজনৈতিক মদতে কেউ অবৈধ ভাবে বালি তুলতেই পারে। কিন্তু নদীর ধারেই তো বালি বিক্রি হচ্ছে না! বালি বোঝাই ট্রাককে যে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়, সেখানে চেকপোস্ট থাকলে জরিমানা আদায় করা অনেক সহজ হবে। বস্তুত, অবৈধ বালি খাদান নিয়ে এখন রাজ্য সরকারও নড়েচড়ে বসেছে। প্রতিটি বালি খাদানের কাছে চেকপোস্টও তৈরি করতে চাইছে রাজ্য সেচ দফতর।
কিন্তু, ভাবা যতটা সহজ, বাস্তবে তা করা ততটাই কঠিন। ভূমি সংস্কার দফতরেরই এক পদস্থ আধিকারিকের কথায়, “কে চেকপোস্ট করতে দেবে! কোটি কোটি টাকার ব্যাপার থাকায়, এক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলই যে এক ছাতার তলায় চলে আসে। ভূমি সংস্কার দফতরের আধিকারিকদের একাংশের সঙ্গে যেমন এদের যোগ রয়েছে তেমনি লাভের একটা অংশ তো সব রাজনৈতিক দলও পায়। তাই কেউ মুখ খোলে না।”

(চলবে)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.