|
|
|
|
সংরক্ষণের দাবি এলাকাবাসীর |
নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় মন্দির
কিংশুক গুপ্ত • লালগড় |
নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় লালগড়ের নেতাই গ্রামের অদূরে ডাইনটিকরি মৌজার প্রাচীন যুগের এক অনুপম পুরাকীর্তি। মাকড়া (ঝামা) পাথরের তৈরি ওই মন্দিরটি উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে এখন ধ্বংসের পথে। নেতাই থেকে কিলোমিটার দেড়েক দূরে ডাইনটিকরি গ্রামে কংসাবতী নদীর পাড়ে রয়েছে মন্দিরটি। দিনের পর দিন যেভাবে নদীর পাড় ভাঙছে, তাতে প্রাচীন যুগের এই নিদর্শনটি যে কোনও সময় নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়ায় আশঙ্কায় এলাকাবাসীরা। মন্দিরটিকে নিয়ে একাধিক গবেষক ক্ষেত্র-সমীক্ষা করেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, এটি বৌদ্ধযুগের একটি উপাসনালয়। জনশ্রুতি, গ্রামের দক্ষিণে অর্থাত্ ডান দিকে ‘টুকরো সম্পদ’ এই মন্দিরটি। তা থেকেই গ্রামের নাম হয়েছে‘ডাইনটিকরি’।
মন্দিরটিকে বাঁচানোর জন্য ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ-এর হস্তক্ষেপ দাবি করে প্রশাসনিক মহলে বেশ কয়েক বার স্মারকলিপিও দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু মন্দির সংরক্ষণের কোনও কাজই হয় নি। স্থানীয় গবেষক পঙ্কজকুমার মণ্ডল দীর্ঘদিন এই মন্দির নিয়ে ক্ষেত্র-সমীক্ষা করে বহু তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ২০০৭ সালে ‘মেদিনীপুরের গ্রামের কথা’ বইটির দ্বিতীয় খণ্ডে পঙ্কজবাবুর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। সেখানে ডাইনটিকরি গ্রামের ওই মন্দির সম্পর্কে পঙ্কজবাবু লিখেছেন, “খ্রিস্টিয় একাদশ-দ্বাদশ শতকে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমান। মন্দিরটি পূর্বমুখী। পঞ্চরথ পীঢ়া দেউল রীতির। চৌকো, আয়তাকার ঝামা পাথর অনুপম জ্যামিতিক স্তরে স্তরে সাজিয়ে মন্দিরটি তৈরি হয়েছে। মন্দিরের চূড়োয় ন’টি ধাপ। ভিতরের ছাদটি লহরা (ঢেউ খেলানো) পদ্ধতিতে নির্মিত।”
মন্দিরের সামনে রয়েছে মাটির ঢিবি। অনুমান, সেটির ভিতর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থাকতে পারে। তবে আজ পর্যন্ত ঢিবিটি খনন করা হয় নি। মন্দিরের আশেপাশে এখনও প্রাচীন পাত্রের ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। গবেষকদের অনুমান, সেগুলি যাগযজ্ঞ বা ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে ব্যবহৃত মৃত্পাত্রের অংশ বিশেষ। স্থানীয় প্রবীণদের কথায়, এক সময় মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে একটি সুড়ঙ্গ কংসাবতী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যদিও কালের গর্ভে ওই সুড়ঙ্গ এখন মাটিচাপা পড়ে গিয়েছে। |
লালগড়ের ডাইনটিকরি গ্রামের সেই মন্দির। ছবি: দেবরাজ ঘোষ। |
ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতক পর্যন্ত মেদিনীপুরের একটি বিস্তীর্ণ অংশ ওড়িশার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওই সময় এলাকায় বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। ফলে, লালগড়ের ওই প্রাচীন উপাসনালয়টি সম্ভবত বৌদ্ধ সংস্কৃতিরই নিদর্শন। এ বিষয়ে অবশ্য আরও গবেষণা করা প্রয়োজন। তবে প্রাথমিক ভাবে অনুমান, বৌদ্ধ তন্ত্র সাধনার কেন্দ্র ছিল মন্দিরটি। কেন না স্থানীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, পরবর্তী কালে হিন্দু রাজাদের আমলে এই অঞ্চলে বৌদ্ধ সংস্কৃতির অবলুপ্তি ঘটেছিল।
নেতাই গ্রামের প্রবীণ শিক্ষাব্রতী দ্বারিকানাথ পণ্ডা বলেন, “ছোট বেলা থেকে শুনে এসেছি ওই মন্দিরটি বৌদ্ধ বিহার ছিল। পরে লালগড় রাজ পরিবারের তরফে ষাটের দশক পর্যন্ত প্রতি বছর দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীর রাতে বিগ্রহহীন ওই মন্দিরে ‘রংকিনি’ নামে এক কল্পিত দেবীর উদ্দেশ্যে পুজো দেওয়া হত। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হওয়ার পর পুজো বন্ধ হয়ে যায়।”
মন্দির নিয়ে রয়েছে নানা লোককথা। জনশ্রুতি, রংকিনি নামে এক রাক্ষসী ওই মন্দিরে থাকত। সে জোর করে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে খাবার আদায় করত। প্রতিদিন একজন করে মানুষকে সে খেত। রাক্ষসীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন গ্রামবাসীরা। একদিন এক রাখাল বালকের পালা পড়েছিল রাক্ষসীর কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু চতুর রাখাল এক বাটি চুনজল দই বলে রাক্ষসীকে খেতে দেয়। চুনজল খেয়ে রাক্ষসীর গলা জ্বলে যায়। তারপর থেকেই রাক্ষসী গ্রাম ছেড়ে পালায়।
গবেষকদের ধারণা, পরবর্তী কালে হিন্দু ধর্মের প্রাবল্যের কারণে প্রাচীন যুগের বৌদ্ধদেবীকে রাক্ষসী আখ্যা দেওয়া হয়। সেই কারণেই মন্দিরটির ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। স্থানীয় বাসিন্দাদের অবশ্য দাবি, মন্দিরটিকে ঘিরে এলাকায় পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারে।
লালগড়ের বিডিও অভিজিত্ সামন্ত বলেন, “মন্দিরটির বিষয়ে বাসিন্দাদের বক্তব্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।”
লালগড় থেকে নেতাই হয়ে ডাইনটিকরির দূরত্ব ৬কিমি। যে কোনও দিন মন্দিরটি দেখার জন্য যাওয়া যেতেই পারে। ভাবতে অবাক লাগে, সে যুগে সিমেন্টের ব্যবহার ছিল না। তা সত্ত্বেও কীভাবে পাথরের উপর পাথর বসিয়ে মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছে, সেটাই বিস্ময়ের! বছরের পর বছর ঝড়ঝঞ্ঝা সহ্য করে মন্দিরটি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক অজানা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে! |
|
|
|
|
|