বিমল গুরুঙ্গের ছেড়ে যাওয়া পদের জন্য নির্বাচন। এবং তাতে ফেরার সুযোগ বিমল গুরুঙ্গের!
পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে জিটিএ-র চিফ এগ্জিকিউটিভ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন বিমল। সেই ইস্তফা তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করেছিল মহাকরণ। তার পর জিটিএ-র পরবর্তী প্রধান নির্বাচন করার কথাও বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, আগামী ৪ সেপ্টেম্বর জিটিএ-র সভা ডেকে নতুন চিফ এগ্জিকিউটিভ নির্বাচন করা হোক। এবং সেটা করতে হবে জয়ী সদস্যদের মধ্যে থেকে, মনোনীত সদস্যদের মধ্যে থেকে নয়। এই নির্দেশ পেয়ে জিটিএ-র প্রধান সচিব রামদাস মিনা জিটিএ-র ৪৫ জন সদস্যকে ওই সভায় আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করেছেন বলে সরকারি সূত্রের খবর। জিটিএ সদস্যদের মধ্যে বিনয় তামাঙ্গ-সহ ১১ জন এখন জেল হাজতে। সরকারি সূত্রে খবর, তাঁদের কাছেও আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হবে। সব থেকে বড় কথা, ওই ১১ সদস্য যদি ৪ সেপ্টেম্বরের সভায় যোগ দেওয়ার জন্য জামিনের আবেদন করেন, তা হলে সম্ভবত তার বিরোধিতা করা হবে না বলেও সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে।
এর ফলে বিমল গুরুঙ্গের পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনা কোথায়?
প্রশাসনিক সূত্রে বলা হচ্ছে, গুরুঙ্গ জিটিএ চিফের পদ থেকে ইস্তফা দিলেও তার সদস্য পদ ছাড়েননি। তাই সভার সদস্যরা ইচ্ছে করলে তাঁকে আবার ওই পদে নির্বাচিত করতে পারেন। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, রাজ্য সরকার এই সুযোগটাই এনে দিয়েছে গুরুঙ্গ এবং মোর্চা নেতৃত্বের সামনে। তাঁদের ব্যাখ্যা, বিভিন্ন স্তরে ক্রমাগত চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি এই সিদ্ধান্ত নিয়ে মোর্চাকে ফের জিটিএ-র স্রোতে ফিরে আসার একটা সুযোগ দিল মহাকরণ। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, বিমল গুরুঙ্গ এখনও জিটিএ-সভার সদস্য। ফলে ৪ সেপ্টেম্বরের সভায় তিনি নিজেই আবার জিটিএ প্রধান পদে নির্বাচিত হতে পারেন। গুরুঙ্গকে সসম্মানে জিটিএতে ফিরিয়ে আনতেই এই পন্থা নেওয়া হয়েছে। মোর্চার সঙ্গে মহাকরণ যে সুসম্পর্ক চায়, এর মাধ্যমে সেই বার্তাই দিচ্ছে সরকার।
গুরুঙ্গ কি জিটিএ চিফের পদে ফিরবেন? জবাবে মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরির বক্তব্য, “৩০ অগস্ট পরের বৈঠক হবে। সেখানে সব কিছু নিয়ে আলোচনা হবে। পরের আন্দোলনের রূপরেখাও তৈরি হবে।”
গুরুঙ্গ জিটিএ-র প্রধান হতে না চাইলে পাহাড়কে সক্রিয় রাখতে দ্বিতীয় পরিকল্পনাও রয়েছে প্রশাসনের। এক সরকারি কর্তা জানান, সরকার যা চাইছে, মোর্চা নেতৃত্ব তা মেনে নেবেন,
এমন নয়। তাই প্রধান সচিবের অফিস চালানো-সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজের লক্ষ্যে তিন মাসের জন্য জিটিএ-তে ৫০ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার, পুলিশ অফিসার এবং সরকারি কর্মী নিয়োগ করা হবে। বিভিন্ন এলাকায় রেশন কার্ড ধরে ধরে রেশন বিলির ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
সরকারি সূত্রে আরও জানানো হয়েছে, আগামী মাসের গোড়ায় লেপচা সম্প্রদায়ের ডাকে এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে গুরুঙ্গদের উপরে চাপ বাড়ানোর কৌশল নিয়েছিল রাজ্য। অনুষ্ঠানটি আপাতত পিছিয়ে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত ১০ সেপ্টেম্বর দার্জিলিং যাবেন, যা কি না ৪ তারিখের সভার পরে। বলা হচ্ছে, এখানেও গুরুঙ্গদের উপরে চাপ কিছুটা হাল্কা করল মহাকরণ।
তবে ধরপাকড় অভিযান আগের মতোই চলছে। এ দিনও দার্জিলিঙের পোখরিবং থেকে পুরনো মামলায় অভিযুক্ত ৭ মোর্চা নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে পোখরিবং পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগে মামলা রয়েছে।
রাজ্য সরকারের এই নরমে-গরমে চলার কৌশলের সঙ্গে পাহাড়ের মানুষের ক্ষোভের কথাও ভাবতে হচ্ছে মোর্চাকে। লাগাতার অচলাবস্থার জেরে পাহাড়বাসী যে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ, তা মোর্চা নেতারাও টের পাচ্ছেন। এ দিন মোর্চার পাতলেবাসের অফিসে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে বৈঠক করেন গুরুঙ্গরা। সেখানে শাখা সংগঠনগুলির কাছে জানতে চাওয়া হয়, আন্দোলনে কেন আগের মতো লোক হচ্ছে না?
পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তাই শুক্রবার সভায় আক্রমণাত্মক বিবৃতি দেননি মোর্চা নেতারা। গুরুঙ্গ নিজেও সভায় যাননি। রোশন গিরি বলেছেন, “পাহাড়ের সমস্যা আইনশৃঙ্খলা জনিত নয়। এটা রাজনৈতিক সমস্যা। রাজনৈতিক ভাবে সমাধান খোঁজা দরকার।” তবে রাজ্যের উপরে কিছুটা চাপ বাড়ানোর চেষ্টাও করছে মোর্চা। এ দিন রাতে মোর্চার তরফে ঘোষণা করা হয়েছে, পাহাড়ে ধৃত মোর্চা নেতা-কর্মীদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত তিন বিধায়ক বিধানসভা বয়কট করবেন।
মোর্চা যে চাপের মধ্যে, সে খবর পৌঁছেছে মহাকরণেও। এই পরিস্থিতিতে পাহাড়কে স্বাভাবিক রেখে উন্নয়নে গতি আনার জন্য গুরুঙ্গকে আরও একটা সুযোগ দিতে যে রাজ্যের আপত্তি নেই, সেই বার্তা দেওয়ারই সিদ্ধান্ত হয় প্রশাসনে।
প্রশাসনিক কর্তাদের বক্তব্য, এমন বার্তা দেওয়ার পিছনে অন্য একটি কারণও রয়েছে। সেটা কী? তাঁদের মতে, পদত্যাগ করার পর গুরুঙ্গের একমাত্র লক্ষ্য পাহাড়ে জিটিএ-কেই লঘু করে দেওয়া। সে জন্য তিনি পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আবার একই সঙ্গে ঘুরপথে জিটিএ প্রশাসনের উপরে কর্তৃত্ব রাখতেও বদ্ধপরিকর গুরুঙ্গ। জিটিএ-র বাজেট বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। সেই সভার রাশ নিজের হাতে রাখতে তাই অশীতিপর বিরখু ভুষালের মতো মনোনীত সদস্যকে চিফ এগ্জিকিউটিভ করতে চেয়েছিলেন গুরুঙ্গ। মোর্চা নেতৃত্বের সেই চাল সফল হতে দিতে রাজি নয় রাজ্য। তাই মহাকরণ মোর্চার এই প্রস্তাব মেনে নেয়নি। সরকার চায়, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে থেকেই কেউ পরবর্তী চিফ নির্বাচিত হোন। আর সে জন্যই সভা ডেকে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। যার ফলে গুরুঙ্গের আবার জিটিএ-র স্রোতে ফিরে আসার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। গত ২০ অগস্ট জিটিএ-র প্রধান সচিব রামদাস মিনা এবং দার্জিলিঙের জেলাশাসক পুনীত যাদবকে তলব করেছিলেন রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা। তখনই তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রস্তাব মেনে কোনও মনোনীত সদস্যকে সিইও পদে বসাবে না সরকার। বরং ফের জিটিএ-র সভা ডেকে নতুন চিফ নির্বাচন করতে হবে। আর মুখ্যমন্ত্রী দার্জিলিং যাওয়ার আগে ৪ তারিখই এই নির্বাচন সেরে ফেলার জন্য রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা জিটিএ কর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিমল কী করবেন? তাঁর সামনে এখন একমাত্র মুখরক্ষার আশা দেখাচ্ছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব। দিল্লি থেকে রোশনরা খালি হাতে ফিরেছেন। রাহুল গাঁধী তাঁদের সময় দেননি। কিন্তু এখন প্রদীপ ভট্টাচার্যরা চাইছেন, রাজ্যপালের হস্তক্ষেপে মিটুক সমস্যা। সে ব্যাপারে তাঁরা সক্রিয় হতে পারেন, দিল্লিতে এই ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রদীপবাবু। যদিও এ সব নিয়ে এ দিন মোর্চা নেতৃত্ব মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
এই পরিস্থিতিতে বিমল কি জিটিএ-র প্রধান হয়ে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ নেবেন? পাহাড় থেকে মহাকরণ, এটাই এখন কোটি
টাকার প্রশ্ন।
|