পারস্পরিক বিরোধের বীজটা ছিল দীর্ঘদিন ধরেই। এ বার তা প্রকাশ্যে এল। শুক্রবার সল্টলেকের দত্তাবাদে তৃণমূল বিধায়ক সুজিত বসুর দলবলের হাতে তাঁরই সতীর্থ বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের ‘নিগ্রহ’কে কেন্দ্র করে অশান্ত হল এলাকা। উভয় পক্ষই অভিযোগের আঙুল তুলল পরস্পরের দিকে। ঘটনার কথা জেনেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
এ দিনের গোলমালের সূত্রপাত ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের একটি সমীক্ষা নিয়ে। এই প্রকল্পে দত্তাবাদে পুনর্বাসনকে কেন্দ্র করে বহু দিন ধরেই প্রতিরোধের আবহাওয়া ছিল। বাসিন্দাদের সেই প্রতিবাদে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন রাজারহাট-নিউ টাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের হস্তক্ষেপে সেটির আপাত মীমাংসার পরে শুক্রবার ওই সমীক্ষা নিয়ে সব্যসাচীবাবুকেই বাসিন্দাদের বোঝানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ নিয়ে মেট্রো ও সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাসিন্দাদের আলোচনা চলাকালীন হাজির হন সল্টলেকের স্থানীয় বিধায়ক সুজিত বসু ও তাঁর অনুগামীরা। অভিযোগ, তাঁদের আলোচনায় ডাকাই হয়নি। এমনকী, সব্যসাচী এই প্রকল্প ভেস্তে দিতে চাইছেন বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা। এর পরেই দুই বিধায়কের অনুগামীদের সংঘর্ষে কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় বাইপাস সংলগ্ন দত্তাবাদ। রাত পর্যন্ত পরিস্থিতি ছিল থমথমে।
তৃণমূলের অন্দরমহলের খবর, মেট্রোর ওই সমীক্ষা উপলক্ষ মাত্র। দুই বিধায়কের ব্যক্তিত্বের বিরোধ দীর্ঘদিনের। এ দিন তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ফলে বিষয়টিকে তৃণমূলের অন্তর্দলীয় কোন্দল হিসেবে দেখতে চান না নেতৃত্ব। তাঁরা বরং মনে করছেন, এটি দত্তাবাদের বাসিন্দাদের অশান্তির প্রকাশ।
এ দিন বাইপাসের উপরে প্রায় আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পথচলতি মানুষ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সামনেই গোলমাল চলে। পরে দুই বিধায়কই নিজেদের অনুগামীদের সংযত করে গোলমাল মেটান। তাঁদের হস্তক্ষেপেই শুরু হয় সমীক্ষার কাজ। |
ঠিক কী ঘটেছিল দত্তাবাদে?
পূর্ব-নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেট্রো ও নগরোন্নয়ন দফতরের আধিকারিকেরা বেলা এগারোটার কিছু আগে বাইপাসে বেঙ্গল কেমিক্যাল মোড়ে দত্তাবাদে হাজির হন। তখন স্থানীয় ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সিপিএমের রাধানাথ চাঁদ, সল্টলেক পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান তথা বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের উপস্থিতিতে বাসিন্দারা পুনর্বাসনের বিষয়ে জানতে চান। রাস্তায় লোক জড়ো হওয়ায় যান চলাচলে সমস্যা দেখা দেয়। বাসিন্দাদের আবেদন মেনে বাইপাসের সল্টলেক স্টেডিয়ামমুখী লেনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে যানজট হয়।
আচমকাই সাড়ে এগারোটার পরে তৃণমূলের নেত্রী, বিএল ব্লকের বাসিন্দা শ্রগ্ধা চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মহিলারা হাজির হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। কিছুক্ষণ বিক্ষোভ চলার পরে তৃণমূলের ঝান্ডা হাতে একটি দল ওই সভার দিকে ধেয়ে আসে। বন্ধ লেনটির ব্যারিকেড সরিয়ে গাড়ি চলাচল শুরু করান তাঁরা। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ভেস্তে যায় সভা। দু’পক্ষের বচসা শুরু হয়। সুজিত-অনুগামীদের অভিযোগ, সব্যসাচীবাবুর মদতে মেট্রো আধিকারিকদের আটকে রাখা হয়েছে। জোর করে রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে। সুজিত বসুকে না ডাকার অভিযোগও ওঠে। অপর পক্ষের অভিযোগ, সমীক্ষা নির্বিঘ্নে চালু করতেই সভা হয়।
সে সময়েই সল্টলেকের বিধায়ক সুজিত বসু হাজির হলে কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় বেঙ্গল কেমিক্যাল মোড়। দু’পক্ষের তুমুল হাতাহাতি, মারপিটে এক মহিলা-সহ দুই তৃণমূলকর্মী জখম হন। দুই বিধায়ককের মধ্যে কার্যত কিছু সময় উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় ঘিরে উত্তেজনা বাড়ে। দলেরই কর্মীদের হাতে সব্যসাচীবাবুকে কার্যত হেনস্থা হতে দেখে সুজিতবাবু কোনও মতে তাঁকে নিয়ে কার্যালয়ে গিয়ে বসেন। ততক্ষণে পুলিশ পৌঁছেছে। তৃণমূলের কার্যালয়ে ডাকা হয় মেট্রোর আধিকারিকদেরও। পরে কার্যালয় থেকে বেরিয়ে দুই বিধায়ক একসঙ্গে বাসিন্দাদের জানান, মেট্রো এখন শুধু সমীক্ষার কাজ করবে। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন। তার পরেই শুরু হয় সমীক্ষার কাজ।
এ দিনের গোলমাল প্রসঙ্গে সুজিতবাবুর দাবি, সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। তা মিটে গিয়েছে। যদিও তিনি বলেন, “সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলার নামে ব্যস্ত সময়ে জোর করে বাইপাস আটকানো হয়। প্রতিবাদে স্থানীয় বাসিন্দারাই সেই অবরোধ তুলে দেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামলাই।”
সব্যসাচীবাবু পাল্টা বলেন, “পুরমন্ত্রীর নির্দেশে গিয়েছিলাম। সরকারি প্রতিনিধিদের আবেদন করি, প্রকল্পের বিষয়ে বাসিন্দাদের জানান। শান্তিপূর্ণ ভাবেই তা হচ্ছিল। বেশি লোক হয়ে যাওয়ায় রাস্তার একটি অংশ কিছুক্ষণের জন্য ব্যারিকেড করে পুলিশ। স্থানীয় কাউন্সিলরও ছিলেন। তখনই একদল বহিরাগত এসে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে।”
এ প্রসঙ্গে ফিরহাদ হাকিম বলেন, “কত জনকে পুনর্বাসন দিতে হবে, মেট্রোর সমীক্ষায় তা স্পষ্ট হবে।” এ দিনের গোলমাল নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি তিনি। তবে বলেন, “দুই বিধায়কই আমার ঘনিষ্ঠ, পরে তাঁদের সঙ্গে কথা বলব।”
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এ দিন সকালে ছিলেন অসমে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ওই সফর সেরে শহরে ফিরে তিনি এই গণ্ডগোলের খবর পান। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ বিষয়ে খোঁজ নেন।
সূত্রের খবর, মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া তাঁদের পক্ষে কাজ এগোনো মুশকিল। তবে তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, আপাতত সমীক্ষার কাজই হবে। তার পরে এ নিয়ে তাড়াহুড়ো করা হবে না।
|