এখনও সুনসান রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে অগুনতি দেহ। মানুষের নয় অবশ্য। বিড়াল, কুকুর, ছাগল সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসের শহরতলি জামালকার রাস্তায় এখন এদেরই নিথর দেহের স্তূপ। তার মাঝেই নমুনা সংগ্রহের কাজে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। উদ্দেশ্য, কোনও ভাবে গোপনে ওই নমুনাগুলিকে দামাস্কাসের হোটেলে থাকা রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষজ্ঞের দলের হাতে পৌঁছে দেওয়া।
বুধবারের ‘গণহত্যা’র নেপথ্যে যে আসাদ-প্রশাসনই, তা প্রমাণ করতে এতটাই তৎপর সাধারণ মানুষ।
তৎপরতা কমেনি আসাদ-অনুগত সেনারও। অসমর্থিত সূত্রের মতে, বুধবারের মৃত্যুমিছিলের পরও লাগাতার বোমাবর্ষণ হয়ে চলেছে দামাস্কাসের বিষ-গ্যাস আক্রান্ত তিন শহরতলিতে। অদূরেই দামাস্কাসের হোটেলে রয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষজ্ঞ দল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁদের কাউকে আক্রান্ত এলাকাগুলি পরিদর্শনে আসার কথা বলেনি আসাদ-প্রশাসন। শুক্রবার সকালেও আসাদ-সরকারের উপর এক প্রস্ত চাপ বাড়িয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান-কি-মুন। তাঁর প্রশ্ন, সরকার বা বিরোধী সত্য উদ্ঘাটনে বাধা দেবে কেন? তার পরেও অবশ্য নীরব আসাদ-প্রশাসন।
আপাতত তাই গোপনেই নমুনা সংগ্রহ এবং তা রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষজ্ঞ দলের হাতে পৌঁছে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন আইন তারমা, জামালকা এবং জোবারের জীবিত বাসিন্দারা। বিরোধীদের একটি অংশের মতে, ইতিমধ্যেই ওই দলের সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁদের। তার পর, মৃতদেহ থেকে চুল, চামড়া এবং রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে গোপন ক্যুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বিশেষজ্ঞ দলের কাছে। আরও অনেকেই নমুনা সংগ্রহ এবং তা পাঠানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু নিরাপত্তার কড়াকড়ি এড়িয়ে সে চেষ্টা এখনও সফল নয়। আসল সমস্যা অবশ্য অন্য জায়গায়। আর তা হল, আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শনে যত দেরি হবে, তত প্রমাণ সংগ্রহের সুযোগ কমবে। সোজা ভাষায়, নিজেদের কেলেঙ্কারি ঢাকা দেওয়ার জন্য হাতে বাড়তি সময় পেয়ে যাবে অভিযুক্ত আসাদপন্থী সেনা। |
জামালকায় সংগ্রহ করা হচ্ছে বিড়ালের দেহ। ছবি: রয়টার্স। |
কিন্তু বহুমুখী চাপ সত্ত্বেও এখনও দৃশ্যত কোনও হেলদোল নেই কেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের?
আসলে সিরিয়া প্রশ্নে প্রথম থেকেই দ্বিধাবিভক্ত বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলি। রাশিয়া এবং চিন বারবার সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের সমর্থনে সুর চড়িয়েছে। এমনকী, এপ্রিলে যখন আসাদ-সরকারের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল, তখনও প্রেসিডেন্টের সমর্থনেই কথা বলেছিল মস্কো। অন্য দিকে, পশ্চিম ইউরোপ তথা আমেরিকার দৃঢ় বিশ্বাস, আসাদ সরকারের গোপন সংগ্রহে রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে। যা এপ্রিলের হামলাতেও বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। বুধবারের মৃত্যুমিছিলের নেপথ্যেও সেই অস্ত্র। কিন্তু মস্কোর বক্তব্য, তদন্তের আগে বিষয়টি নিয়ে কাঠগড়ায় তোলা উচিত নয় আসাদ-সরকারকে। চিনেরও কার্যত একই দাবি।
অন্য দিকে, ব্রিটেন, ফ্রান্স বুধবারের গণহত্যার বিরুদ্ধে মুখ খুললেও কড়া পদক্ষেপ করার কথা ভাবছে না।
আর আমেরিকা? বুধবারের হামলা নিয়ে সে দেশের অবস্থান এখনও অস্পষ্ট। ওবামা-প্রশাসন জানিয়েছিল, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার হয়েছিল কি না, তা নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি তাঁরা। শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুধু এ টুকু জানান, সিরিয়া সরকারের অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে খুব শীঘ্রই নিজেদের সিদ্ধান্ত জানাবে আমেরিকা। কিন্তু তিনি এও বলেন, “রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশ ও যথাযথ প্রমাণ ছাড়া আমেরিকা যদি অন্য কোনও দেশে ঢোকে এবং হামলা চালায় তা হলে আন্তর্জাতিক আইন ভাঙা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।” কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মতে, আমেরিকার সমর্থন ছাড়া সিরিয়ার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা সম্ভব নয়।
অর্থাৎ ইউরোপ তাকিয়ে আমেরিকার দিকে। আমেরিকার বক্তব্য, রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশ ছাড়া কোনও হামলা নয়। এ দিকে, মৃত্যুমিছিলের দু’দিন পরেও তদন্তে অপারগ রাষ্ট্রপুঞ্জ।
অজানা দ্বিধার ফায়দা তুলছে পেশিশক্তি। যার জেরে গত আড়াই বছরে সিরিয়ায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ লক্ষ মানুষ। আন্তর্জাতিক কূটনীতির জটিলতায় সে সংখ্যা আর কতটা বাড়বে, এখন সেটাই দেখার।
|