স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বছর বাইশের বন্দি যুবক। ‘সাংঘাতিক’ একটা অপরাধ করে ফেলেছেন বলে তাঁকে তিরস্কার করা হচ্ছিল।
অপরাধ বলতে একটা সেলাই মেশিন ভুল করে নীচে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। মেশিনটা এতটাই পুরনো যে সেটা আর সারাই করাও যাবে না। তবু জেলের কারখানার ম্যানেজার চেঁচাচ্ছিল তাঁর উপরে। তার পরে সময় নষ্ট না করে একটা বড় ছুরি নিয়ে যুবকটির ডান হাতের মধ্যমা কেটে দিল সে। বন্দি যুবকের মনে হয়েছিল, গোটা হাতটাই কেটে নেওয়া হবে। ‘অল্প’ শাস্তি পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেলেন তিনি।
গল্পটা উত্তর কোরিয়ার যুবক শিন ডং হুকের। দক্ষিণ কোরিয়ার সোলে রাষ্ট্রপুঞ্জের তদন্ত কমিশনের কাছে এমন নানা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন শিনের মতো তিরিশ জন জেল পালানো বন্দি। যাঁরা এ যুগেও নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বীভৎসতা প্রত্যক্ষ করেছেন। উত্তর কোরিয়ার একনায়ক শাসক কিম জং ইলের সময়কার মারাত্মক ওই ক্যাম্প-১৪ থেকে বেঁচে ফিরেছেন বলে তাঁরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছেন।
শিন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন একটি বইয়ে, ‘এসকেপ ফ্রম ক্যাম্প ১৪।’ ২০০৪ সালে পালিয়ে বেঁচেছেন তিনি। শিমদের অভিজ্ঞতা এতটাই অসহ্য যে শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। তবু রাষ্ট্রপুঞ্জের তদন্ত কমিশন চায়, এই ভয়ঙ্কর কথাগুলো সারা বিশ্বের মানুষ জানুক। ১৯৪৮ সালে কিম পরিবারের শাসন শুরু। কিন্তু একনায়ক কিম জং ইলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার হাজার হাজার মানুষ। শাস্তিস্বরূপ যাঁদের রাজনৈতিক বন্দি করে রেখে দেওয়া হয় বিভিন্ন কলোনিতে। ক্যাম্প-১৪ ও তেমনিই একটি কলোনি। যেখানে কোনও পরিবারের এক জন সদস্য কিমের বিরোধিতা করায় তিন প্রজন্ম ধরে সেই শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। |
উত্তর কোরিয়ার চংসং প্রদেশে একটি মহিলা জেলের সামনে রক্ষী। ছবি: রয়টার্স। |
১৯৮২ সালে শিনের জন্ম হয়েছিল ক্যাম্প-১৪য়। তাই ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরেই ‘অপরাধী’র তকমা লেগে গিয়েছে তাঁর গায়ে। শিনের দুই কাকা ষাটের দশকে পালাতে চেষ্টা করেছিলেন। শিনের বাবা-মায়ের বিয়েও হয় ক্যাম্পে। চোখের সামনে শিন মরতে দেখেছেন নিজের মা আর ভাইকে। শৈশব-স্মৃতিতে সেটাই টাটকা। যাঁরা পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়তেন, দ্রুত মেরে ফেলা হত তাঁদের। পালিয়ে যেতে পারলে সেই বন্দির পরিবারের বাকি সদস্যদের হেনস্থা করা হত নানা ভাবে।
কী ভাবে মারা হত? ক্যাম্পের কম্যান্ড্যান্টের মর্জির উপরে সেটা নির্ভর করে। প্রাক্তন বন্দি কাং চোল-হাওয়ান তাঁর লেখা বইয়ে জানিয়েছেন সে কথা “বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাউকে মারার আগে তার মুখে ভর্তি করে দেওয়া হত পাথর। যাতে সে আর চিৎকার করতে না পারে। চোখ, বুক এবং কোমরে বাঁধা হত দড়ি। তার পরে প্রথমে সরাসরি মাথায় গুলি। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। তার পরে বুকে। যার জেরে দেহটা একটু ঝুঁকে পড়ে। একেবারে শেষে কোমরে। এ বার সামনে খুঁড়ে রাখা গর্তে দেহটা পড়ে যায়। কবর দেওয়ার কাজটা সহজ হয়ে যায়! আর অন্য বন্দিদের বলা হয়, ওই দেহ লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে। যত ক্ষণ না লাশের চামড়া উঠে আসে।” কাং লিখছেন, “এক দিন একটা মাঠে বুলডোজার ঠেলে জমি সমান করা হচ্ছিল। দেখলাম উঠে আসছে হাত, পা, পায়ের পাতা। কোনওটায় তখনও মোজা পরানো। গা গুলিয়ে উঠেছিল। আবর্জনার স্তূপে সেই সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তুলে ফেলতে বলা হয়েছিল আমায়।”
এ রকম বিভিন্ন কাজ করানো হত বন্দিদের দিয়ে। অকারণে যখন তখন শাস্তি দেওয়া হত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটু মুড়ে বসিয়ে রাখা অথবা একটা বাক্সে টানা ১৫ দিন গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে হত বন্দিদের। জুটত না খাবার। উপোসী মানুষগুলো বাধ্য হয়ে ইঁদুর, ব্যাঙ, সাপ, পোকামাকড় যা পেত, খেত। এ সব খেত শিশুরাও। কাংয়ের কথায়, মাটিতে যা হেঁটে যেত, বাচ্চাগুলো তাই খুঁটে খেত। মজুত করা খাবার চুরি করলে বাচ্চাদের মারাত্মক শাস্তি দেওয়া হত। ছ’বছরের একটি মেয়ের জামার পকেটে এক রক্ষী খুঁজে পান ভুট্টার পাঁচটা দানা। সেই অপরাধে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে লাঠি দিয়ে বারবার তার মাথায় মারা হয়। নাক থেকে রক্ত ঝরছে। বাকি শিশুদের বাধ্য করা হচ্ছে সে দৃশ্য দেখতে। মেয়েটি সেই সন্ধ্যাতেই মারা যায়।
শিউরে ওঠার মতো গল্প শোনালেন আর এক জেল পালানো বন্দি জি হিওন-আ। সন্তানকে নিজের হাতে জলের তলায় ডুবিয়ে মেরে ফেলতে বাধ্য করা হয়েছিল এক মাকে। জি বলছেন, “হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওই মা বার বার রক্ষীর কাছে অনুনয় করছিলেন। রক্ষী কিন্তু তাঁকে মেরেই যাচ্ছিল। শেষমেশ কাঁপা হাতে মা নিজের শিশুকে শুইয়ে দিলেন জলের তলায়। একটু পরেই বাচ্চাটার কান্না থেমে গেল।”
অ্যাডল্ফ হিটলার নয়, এ দেশের বর্তমান শাসকের নাম কিম জং-উন। জেগে জেগে যিনি অনেক স্বপ্ন দেখেন। যেমন এখন ভাবছেন, একটা স্কি-রিসর্ট বানাবেন দেশের মানুষের জন্য!
রাষ্ট্রপুঞ্জের তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হবে কি? অপেক্ষায় উত্তর কোরিয়া। |