হাইকোর্ট বৃহস্পতিবার রায় দিয়ে বলেছে, শান্তিনিকেতনের খোয়াই কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত করা চলবে না। সেখানকার প্রাকৃতিক ও ঐতিহ্যগত ভাব বজায় রাখতে হবে।
কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ বৃহস্পতিবার রায়ে বলেছে, খোয়াইয়ে যে সব নির্মাণ কাজ চলছে তা বন্ধ রাখতে হবে। যে সব নির্মাণ শেষ হয়েছে, তা আইনগত পদ্ধতিতে ভেঙে দিয়ে ঐতিহ্যমণ্ডিত এই স্থানকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে। এই নির্দেশের পরেই হইচই পড়ে গিয়েছে। আবাসনের বাসিন্দারা কী করবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, “রবীন্দ্রনাথের গড়ে তোলা শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনকে স্বমহিমায় বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এ নিয়ে কোনও আপস করা যাবে না।”
খোয়াইয়ের ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে গড়ে ওঠা চারতলা আবাসন তৈরির বিরোধিতা করে হাইকোর্টে জনস্বার্থের মামলা করেছিলেন শিল্পী যোগেন চৌধুরী। আদালত খোয়াইয়ের অন্যান্য বেআইনি নির্মাণের সঙ্গে এই আবাসনটিও ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। ভেঙে ফেলার খরচ হিসাবে আবাসনের মালিককে ১০ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা দিতে হবে বলেও জানিয়েছে আদালত।
আবাসন প্রকল্পের মালিক তথা ডিরেক্টর অর্পণ মিত্র বলেন, “সংশ্লিষ্ট দফতরগুলি থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে প্রায় দু’বছর ধরে ওই আবাসন তৈরি হয়েছে। খাজনা বাবদ রূপপুর পঞ্চায়েতকে ১৮ হাজার টাকা, মহকুমার সহ-শ্রম কমিশনারের দফতরে ৩ লক্ষ টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলি ‘নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট’ও দিয়েছে। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরও সব দিক যাচাই করে আমাদের ছাড়পত্র দিয়েছে। এর পরেও এই নির্মাণ কী ভাবে অবৈধ হয় বুঝতে পারছি না!” অর্পণবাবু জানান, আবাসনটিতে ইতিমধ্যেই ২৫টি পরিবার থাকতে শুরু করেছেন। এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া ছাড়া তাঁর অন্য কোনও পথ নেই। |
হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে চিত্রকর যোগেন চৌধুরী বলেন, “অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। তবু এই রায় দৃষ্টান্ত তৈরি করল। ভবিষ্যতে ওখানে যাতে আর কোনও নির্মাণ না হয়, তার জন্য বিচার ব্যবস্থাকে সজাগ থাকতে হবে।” বিশ্বভারতীর মিডিয়া ইন্টারফেস কমিটির চেয়ারপার্সন সবুজকলি সেন বলেন, “খোয়াই অনেকটাই নষ্ট করা হয়েছে। আদালতের এই রায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।” রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আদালতে রিপোর্ট দিয়ে জানিয়েছিল, খোয়াইয়ের ধারে সব নির্মাণই অবৈধ। এই সব নির্মাণ প্রকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে।
২০১১ সালের নভেম্বরে অনুমতি পাওয়ার পরে শান্তিনিকেতনের বল্লভপুর অভয়ারণ্য লাগোয়া ২৯ কাঠা জায়গায় ৫ কোটি টাকা খরচ করে আবাসন প্রকল্পের কাজ শুরু করে ‘আশুদয় প্রোজেক্ট অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রাইভেট লিমিটেড’। প্রকল্পটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা অবনীভূষণ মণ্ডল জানান, অমর্ত্য সেনের মা অমিতা সেনের কাছ থেকে ওই বছরই জমিটি কেনা হয়। অথচ তার এক বছর আগে, ২০১০ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছিল, বিশ্বভারতী লাগোয়া ১১টি মৌজায় কোনও নির্মাণের অনুমতি দেওয়া যাবে না। তবু রূপপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অনুমতি নিয়ে কী করে এই সব আবাসন গড়ে উঠল, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
বল্লভপুর অভয়ারণ্য লাগোয়া এলাকায় বহুতল আবাসন গড়ার বিরোধিতায় স্থানীয় বাসিন্দারা বারবার সরব হয়েছেন। মাস চারেক আগেও মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে চিঠি পাঠিয়েছেন যোগেন চৌধুরী-সহ বিশিষ্ট জনেরা। ব্যক্তি মালিকানাধীন বাড়ি থেকে আবাসন সরকারি ছাড়পত্র নিয়ে খোয়াইয়ে তৈরি হওয়া এমন নির্মাণ কয়েকশো ছাড়িয়েছে।
খোয়াই নষ্ট করে নির্মাণে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ এনে এক সময়ে বোলপুরের তৎকালীন সাংসদ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। সোমনাথবাবু এ দিন বলেন, “আমি ওই রায় বিশদে জানি না। তবে খোয়াই ঠিক কোন জায়গাটা, সেটাই এখনও মীমাংসা হয়নি। আমি সাংসদ থাকার সময়ে খোয়াই নিয়ে কিছু মানুষ সরব হয়েছিলেন। অমর্ত্য সেন তো বলেছিলেন, এই আন্দোলন হাস্যকর। আমি একটা স্কুল গড়ার চেষ্টা করেছিলাম। সেটার শিলান্যাসও হয়। কিন্তু কিছু মানুষ সেখানে ঢুকে লাথি মেরে কী করেছিলেন, তা আপনারা ভালই জানেন!” সেমনাথবাবুর অভিযোগ, যাঁরা খোয়াই বাঁচাও নিয়ে এক সময়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরাও এখন খোয়াইয়ে বাড়ি করছেন। এই আমলেই এই সব হয়েছে।
খোয়াইয়ে নির্মাণ করা নিয়ে অভিযোগের আঙুল উঠেছে যোগেনবাবুর বিরুদ্ধেও। এ নিয়ে তাঁর বক্তব্য, “আমরা তো কোনও ব্যবসা করছি না। ওখানে সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র গড়েছি। ওই নির্মাণ আদতে একটি সুন্দর স্থাপত্যশিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে, কোনও কংক্রিটের জঙ্গল নয়। বিশ্বভারতীর নিয়ম মেনে তা দোতলার বেশি উঁচুও করা হয়নি।”
|