সাড়া দিল না জনতা,
সঞ্চয় প্রকল্প নিয়ে সংশয়ী রাজ্যই
রাজ্যের নিজস্ব সঞ্চয় প্রকল্প। সুদের হার কম হলেও টাকা ফেরতের একশো শতাংশ নিশ্চয়তা।
সারদা-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে মূলত এই অভিপ্রায়ের কথা জানিয়ে সরকারের তরফে সঞ্চয় প্রকল্প চালুর কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তা মাস চারেক আগের ঘটনা। কিন্তু আমজনতার দিক থেকে বিশেষ ইতিবাচক সাড়া না-মেলায় ও নিয়ম-বিধির জটিলতায় এখন আর এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে না রাজ্যের অর্থ দফতর। বস্তুত অর্থলগ্নি সংস্থার নানাবিধ অবৈধ কারবারের মোকাবিলায় এমন প্রকল্প আদৌ কার্যকরী কি না, অর্থ-কর্তাদের একাংশও সে ব্যাপারে সন্দিহান। ওঁদের কথায়, “যেখানে খোদ কেন্দ্রের ডাকঘর স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প মজুত, সেখানে রাজ্যের এ হেন উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখবে, এটা হলফ করে বলা যায় না।”
এমতাবস্থায় উদ্যোগটি কার্যত ধামাচাপা পড়ে রয়েছে। মহাকরণের খবর: প্রস্তাব সম্পর্কে ‘মতামত’ আসার পরে এ বিষয়ে ফাইল তৈরি করে মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে কোনও নির্দেশ এখনও আসেনি। অর্থ দফতরও তাই আপাতত হাত গুটিয়ে। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র অবশ্য এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সারদা-কাণ্ডের পরে আমানতকারীদের ভরসা দিতে দু’টি প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছিলেন, সারদার আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে সরকার পাঁচশো কোটি টাকার তহবিল গড়বে। পাশাপাশি জানিয়েছিলেন সরকারের নিজস্ব সঞ্চয় প্রকল্প চালু করার পরিকল্পনা। এ ব্যাপারে গত ৮ মে মহাকরণে তিনি বলেন, “এটা অনেকটা সোশ্যাল সিকিউরিটি স্কিম ধাঁচের। এতে সরকারের কাছে সাধারণ মানুষ টাকা গচ্ছিত রাখবেন। হয়তো বেশি সুদ দিতে পারব না। কিন্তু প্রতারণাও হবে না। টাকাটা মার যাবে না, সুরক্ষিত থাকবে।” মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, “মানুষ টাকা রাখার নিশ্চিন্ত জায়গা খুঁজছেন। ডাকঘরে-ব্যাঙ্কে আস্থা কমেছে। সুদ কমেছে। ওই সংস্থাগুলি (সারদার মতো লগ্নিসংস্থা) বেশি সুদের প্রলোভন দিচ্ছে। তাই মানুষ যেখানে-সেখানে টাকা রাখছেন।” প্রশাসনের একাংশেরও ধারণা ছিল, সারদা-সহ বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার বেআইনি কারবারের কথা জেনে মানুষ সতর্ক হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার নিজস্ব সঞ্চয় প্রকল্প চালু করলে বাজার থেকে বহু কোটি টাকা তোলা যাবে। তা লগ্নি করে বা অন্যত্র খাটিয়ে রাজকোষের দৈন্যদশা কিছুটা কাটানো যাবে বলে আশা করা হয়েছিল।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে অর্থ দফতরের ওয়েবসাইটে প্রস্তাবটি দিয়ে জনসাধারণের মতামত চাওয়া হয়। মতামত পেশের জন্য সময় দেওয়া হয় এক মাস। সময়সীমা ফুরোলে দেখা যায়, সাকুল্যে ৭০টি মন্তব্য জমা পড়েছে, যার অনেকগুলোই নেতিবাচক। যেমন কেউ লিখেছেন, ‘খুব ভাল, আর একটা সারদা হবে।’ কারও বক্রোক্তি, ‘যত সব আজগুবি কারবার! সরকারের কি অন্য কাজ নেই?’ কারও কটাক্ষ, ‘২৮% ডিএ বাকি! ওই টাকা দিয়েই এখন সারদার টাকা মেটানো হচ্ছে!’
অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, “৭০টির মধ্যে কয়েকটি প্রস্তাবে কিছু সারবত্তা ছিল। বাকিগুলো অবিবেচকের মতো লেখা। মতামত দেওয়ার বদলে সারদা-কাণ্ড নিয়েই ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন কিছু মানুষ।” সরকারের আশা ছিল, আইনি পরামর্শদাতা সংস্থা, বিশিষ্ট নাগরিক বা অর্থনীতির লোকজনের কাছ থেকেও সাইটে লিখিত মতামত মিলবে। সে ক্ষেত্রেও হতাশ হতে হয়েছে বলে দফতর-সূত্রের খবর।
তবে ওই সময়ে বিশেষজ্ঞ মহলে প্রকল্পটির বাস্তবতা নিয়ে কিছু পরস্পর-বিরোধী সুর শোনা গিয়েছিল। যেমন অর্থনীতির শিক্ষক সুগত মারজিতের প্রশ্ন ছিল, “সরকার নিজে এ ধরনের কাজ করতে যাবে কেন? বরং সরকারের উচিত যেখানে ব্যাঙ্ক এখনও
পৌঁছায়নি, সেই সব জায়গা থেকে আমানত সংগ্রহ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে রাখার ব্যবস্থা করা।” সুগতবাবুর মতে, সারা দেশে যে ভাবে অর্থলগ্নি সংস্থার জাল ছড়িয়েছে, তাতে এর ঝুঁকি এড়ানো বড়ই কঠিন। পাল্টা মত দিয়ে অর্থনীতির আর এক শিক্ষক অভিরূপ সরকার দাবি করেন, এমন একটা প্রকল্প হওয়া উচিত, এবং তা সম্ভবও। কী ভাবে?
তাঁর যুক্তি ছিল, ডাকঘরের স্বল্প সঞ্চয় যে হেতু ঠিকঠাক চলছে না, তাই রাজ্য এমন একটা প্রকল্প চালু করে বাজার থেকে টাকা তুলতে পারলে নিজের ঋণভার কিছুটা লাঘব করতে পারবে, আমানতকারীদেরও কিছু বাড়তি সুদ দেওয়া যাবে। এ জন্য অবশ্য রাজ্য সরকারকে আমানত সংগ্রহকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার ছাড়পত্র আদায় করতে হবে বলে জানিয়েছিলেন অভিরূপবাবু।
অর্থ দফতরের এক কর্তাও জানাচ্ছেন, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে এমন কোনও প্রকল্প চালাতে গেলে কেন্দ্রের অনুমোদন আবশ্যিক। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ছাড়পত্র প্রয়োজন। আবার বাজার থেকে টাকা তুলতে হলে সেবি’র মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকেও অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। মহাকরণের খবর: কেরল সরকারের উদ্যোগে এই সব নিয়মকানুন মেনেই লগ্নি-কারবার চালানো হয়। ‘প্রাইজ চিট অ্যান্ড মানি সার্কুলেশন’ আইন মেনে তা রাজ্য সরকারের অধিগৃহীত ‘চিট ফান্ড’ হিসেবে কাজ করে। সেখানে বহু মানুষ টাকা জমান, মেয়াদশেষে ফেরত পান। রাজ্য সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় সঞ্চয় প্রকল্পের এমন নজির দেশে থাকায় পশ্চিমবঙ্গেও সরকারি স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প চালু করার কথা প্রাথমিক ভাবে ভাবা হয়েছিল বলে মহাকরণ-সূত্রে জানা গিয়েছে।
কিন্তু এর মাঝে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক সিদ্ধান্তে রাজ্য বেকায়দায় পড়ে যায়। নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি (এনবিএফসি) হিসেবে কাজ করার অনুমোদন ছিল রাজ্যের দু’টি সরকারি সংস্থার পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগম (ডব্লিউবিআইডিসি) এবং পশ্চিমবঙ্গ শিল্প পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগম (ডব্লিউবিআইআইডিসি)-এর, যদিও তারা কখনও আমানতকারীদের থেকে টাকা তোলেনি। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সঞ্চয় প্রকল্পের সাত-সতেরো নিয়ে মহাকরণে চিন্তা-ভাবনা চলাকালীন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রাজ্যকে জানিয়ে দেয়, নিগম দু’টি আর বাজার থেকে টাকা তুলতে পারবে না। তাদের এনবিএফসি-লাইসেন্স রদ করা হয়।
ফলে পরিকল্পনা গোড়াতেই বড় হোঁচট খায়। কেন্দ্রীয় অনুমোদন আদায়ের জটিলতা তো আছেই, উপরন্তু আমজনতার বড় অংশে উৎসাহের অভাব পরিস্থিতিকে আরও প্রতিকূল করে তুলেছে বলে জানিয়েছেন অর্থ দফতরের এক কর্তা। তাঁদের বক্তব্য, এই মুহূর্তে সঞ্চয় প্রকল্প নিয়ে এগোনোর পরিবর্তে বিচারপতি শ্যামল সেন কমিশন মারফত সারদার কিছু আমানতকারীর টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করাটাই সরকারের কাছে অগ্রাধিকার।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.