যৌথ চাষের পরে সঙ্ঘবদ্ধ চাষ। জোড়া পদক্ষেপে কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার করতে চাইছে রাজ্য সরকার।
বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চাষিরা যাতে চুক্তির ভিত্তিতে চাষ করতে পারেন, সে জন্য আইন তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই নিয়েছে রাজ্য। তার সঙ্গে মধ্যসত্ত্বভোগীদের হাত থেকে চাষিদের বাঁচাতে সঙ্ঘবদ্ধ চাষের অনুমতি দেওয়ার পথেও হাঁটতে চলেছে তারা। নতুন প্রকল্পে চাষিরা জোটবদ্ধ হয়ে চাষ করা ছাড়াও, ফসল কোথায় বিক্রি করবেন, সেই স্বাধীনতাও দেওয়া হচ্ছে তাঁদের। মহাকরণের এক কর্তা বলেন, “ন্যায্য দামে সব্জি বিক্রির সুযোগ দিতে সরকার কৃষি বাজারগুলি চাষিদের ছেড়ে দেবে। কিন্তু তার বাইরেও যদি সম্মিলিত ভাবে কোনও বেসরকারি সংস্থার কাছে ফসল বিক্রির সিদ্ধান্ত তাঁরা নেন, সেই সংস্থানও রয়েছে প্রকল্পে।” কৃষি দফতরের এক কর্তার মতে, এ রাজ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির সংখ্যা এত বেশি যে পাইকারি বাজারে ফসলের দাম তাঁরা কখনওই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। সঙ্ঘবদ্ধ চাষ শুরু হলে মহাজন ও ফড়েদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জমি তৈরি হবে। এ রাজ্যে চাষের জমি বহু মালিকানায় বিভক্ত হওয়ার কারণে সঙ্ঘবদ্ধ চাষে সাড়া মিলবে বলেও তাঁর আশা।
সঙ্ঘবদ্ধ চাষে ক’বছর ধরে উৎসাহ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রক। গুজরাত, ওড়িশা, ছত্তীসগঢ়ের মতো রাজ্য আগেই সে পরামর্শ মানলেও এ রাজ্যের বাম সরকার সেই পথে হাঁটেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে যৌথ চাষের মতো সঙ্ঘবদ্ধ চাষেও সম্মতি দিতে চলেছেন। এই প্রকল্প সম্পর্কে মহাকরণের এক কর্তা বলেন, “কৃষি মন্ত্রকের অধীন ‘স্মল ফারমার্স এগ্রি বিজনেস কনসর্টিয়াম’ (এসএফএসি) নামে একটি সংস্থা সঙ্ঘবদ্ধ চাষের মূল কাজটা করে। শুধু ফসল ফলানো নয়, আড়তদারের কাছে ফসল বিক্রি পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দেয় তারা। মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন, এ রাজ্যেও চাষিদের সঙ্ঘবদ্ধ চাষে উৎসাহিত করা হোক। সেই জন্য গত জুলাইয়ের গোড়ায় ওই সংস্থার সঙ্গে সমঝোতাপত্রে সই করেছে কৃষি বিপণন দফতর।” দফতর সূত্রের খবর, কয়েক দিন আগেই এসএফএসি-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রভাস শর্মা মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন। কাজ শুরুর আগে এ রাজ্যের চাষবাসের অবস্থা ও ফসল বিক্রির পরিকাঠামো সম্পর্কে ধারণা পেতে তিনি কৃষিকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
কী ভাবে কাজ করবে এসএফএসি? কৃষি দফতরের এক কর্তা বলেন, “প্রথমে এলাকা ধরে চাষিদের ছোট ছোট দল তৈরি হবে। প্রতি দলে থাকবে ১০-১৫ জন। ওই দলগুলিকে বলা হচ্ছে, ‘ফার্মার্স ইন্টারেস্ট গ্রুপ’ (এফআইজি)। সেই দল থেকেই এক জন বা দু’জন করে প্রতিনিধি নিয়ে গড়া হবে ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন (এফপিও)। নদিয়া ও হুগলির কিছু এলাকায় ওই কাজ শুরুও হয়ে গিয়েছে।” এ সব কাজ অবশ্য এসএফএসি সরাসরি করবে না। মূলত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমেই চাষিদের এক মঞ্চে আনার কাজ করে তারা। কৃষি বিপণন দফতরের এক কর্তা বলেন, “প্রাথমিক ভাবে চারটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে বাছাই করেছে এসএফএসি। চাষিদের জোটবদ্ধ করার কাজ শুরুও করে দিয়েছে তারা।”
এমনই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ‘স্টেট ম্যানেজার’ সায়ন ঘোষ বলেন, “সর্বোচ্চ ১০০০ জন চাষিকে নিয়ে একটি এফপিও তৈরি হতে পারে। ভোটাভুটির মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে থেকেই একটি কমিটি তৈরি হবে। চাষের উপকরণ কেনা থেকে সব্জি বিক্রি, এমনকী, কোন সব্জি ফলালে বেশি লাভ হবে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে ওই কমিটির। কার্যত তাদের হাতেই থাকবে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ।”
ওই কমিটিতে স্থানীয় বিডিও বা ব্যাঙ্কের অফিসারকে প্রতিনিধি হিসেবে রাখতে বলা হলেও তাঁদের ভোটাধিকার দেয়নি এসএফএসি। এর কারণ হিসেবে এক কৃষিকর্তা বলেন, “কোম্পানি অ্যাক্ট-এ এফপিওগুলি তৈরি হবে। এককালীন টাকা তুলে চাষিরাই তহবিল তৈরি করবেন। তার জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। রোজই ব্যাঙ্কের সঙ্গে লেনদেন চলবে। তাতে সাহায্য করতেই বিডিও বা ব্যাঙ্কের অফিসারকে ওই কমিটিতে রাখার কথা বলা হয়েছে।”
চাষিদের আরও নানা ভাবে সাহায্য করার ভাবছে রাজ্য। এক কৃষিকর্তা বলেন, “এফপিওগুলিকে ভর্তুকিতে সার ও কীটনাশক দিতে পারি আমরা। হ্যান্ড-টিলার বা পাওয়ার টিলার কেনার জন্য এককালীন অনুদানও দিতে পারি। তবে এখনও কিছু চূড়ান্ত হয়নি।”
তবে সরকারের অপেক্ষায় না থেকে ইতিমধ্যেই সঙ্ঘবদ্ধ চাষে নেমে পড়েছেন বলাগড়ের সুব্রত কর্মকার ও হরিণঘাটার মোস্তাক হোসেনরা। বলাগড়ের বেলেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা সুব্রতবাবুর সাড়ে ছ’বিঘা জমি আছে। মূলত শশা ও পেঁয়াজের চাষ করেন। কিন্তু এ বার শশার তেমন দাম পাননি। সুব্রতবাবু বলেন, “গত জুনে যখন কলকাতার পাইকারি বাজারে ১২ টাকা কেজি দরে শশা বিক্রি হয়েছে, তখন জিরাট বা কালনায় তিন টাকা করে বিক্রি করেছি। একজোট হয়ে ফসল বিক্রি করলে আশা করি কারও হাতেপায়ে ধরতে হবে না।”
সুবিধা মিলবে অন্যত্রও। সুব্রতবাবু বলেন, “পুরোদমে চাষ করলে আমার বছরে দু’হাজার প্যাক ইউরিয়া লাগে। এত দিন ৩১৫ টাকায় এক বস্তা সার কিনতাম। এফআইজি তৈরি হওয়ার পরে ওই দোকানদারই বস্তাপিছু পাঁচ টাকা কমাতে রাজি হয়েছেন। অর্থাৎ, কেবল ইউরিয়াতেই বছরে ১০ হাজার টাকা খরচ কমল আমার।” একই সুর মোস্তাক হোসেনের গলাতেও। হরিণঘাটার কাষ্ঠডাঙার ওই চাষির বক্তব্য, “এক বিঘা জমিতে টোম্যাটো চাষ করে ১০ হাজার টাকাও ঘরে আনতে পারিনি। হিসেব করে দেখেছি, দল বেঁধে চাষ করলে ওই পরিমাণ ফসলেই দ্বিগুণ লাভ হবে।”
সঙ্ঘবদ্ধ চাষে যখন এতই সুবিধা, তখন বাম সরকার কেন তা এড়িয়ে ছিল? বহু দিন কৃষি বিপণন পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা নরেন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সম্পন্ন চাষি ও কৃষিপণ্যের বড় ব্যবসায়ীদের সুবিধা করে দিতেই কেন্দ্র নানা সুপারিশ করেছিল। ওদের কথা শুনে চললে প্রান্তিক চাষি ও কৃষিপণ্যের খুচরো বিক্রেতারা মারা পড়তেন।”
এ কথা অবশ্য মানতে নারাজ বর্তমান কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায়। তাঁর বক্তব্য, “আগের সরকার নিজেদের চাষিদরদী বলে দাবি করলেও চাষিরা যাতে স্বাবলম্বী হতে না-পারেন, সরকারের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকেন, সেই কৌশলই নিয়েছিল।” |