|
|
|
|
ব্যারাজের জলে বন্যার ভ্রূকুটি দুই জেলায়
নিজস্ব প্রতিবেদন |
যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। একে নিম্নচাপের জেরে তিন দিন ধরে নাগাড়ে হয়ে চলেছে বৃষ্টি। তার উপর দুই মেদিনীপুর সংলগ্ন বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুরের কংসাবতী জলাধার, ঝাড়খণ্ডের গালুডি ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ায় বন্যার ভ্রূকুটি দেখা দিল দুই মেদিনীপুরের একাধিক এলাকায়।
পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে বুধবার বিকালে সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, জলসম্পদ মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র পাঁশকুড়ায় সেচ দফতরের বাংলোয় জেলা প্রশাসন ও সেচ দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন। সেচমন্ত্রী বলেন, “কংসাবতী ও সুবর্ণরেখা নদীর জল আপাতত বিপদসীমার মধ্যে রয়েছে। ওই দুই নদীর ব্যারেজ থেকে জল ছাড়া হয়েছে। পরিস্থিতি সঙ্কটজনক হলেও এখনও বন্যা ঘোষণা করার মতো পরিস্থিতি হয়নি।” পূর্ব মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) সাগর সিংহ বলেন, “কৃষি দফতরের হিসাব অনুযায়ী জেলায় ১৪২৪টি মৌজায় প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর আমন ধান ও ৮ হাজার ৬০০ হেক্টর আউশ ধানের জমি জলমগ্ন হয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব এখনই বলা যাবে না।”
কংসাবতী ব্যারেজ থেকে ২০ হাজার কিউসেক জল ছাড়ায় পাঁশকুড়া, ময়না, তমলুক এলাকায় সতর্কতা জারি হয়েছে। রবিবার বিকাল থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত তিন দিনে জেলায় গড়ে মোট ৩০৮ মিলিলিটার বৃষ্টি হয়েছে। সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, পাঁশকুড়ার রাধাবন এলাকায় ক্ষীরাই-বাস্কী নদীবাঁধে আগেই ভাঙন ধরেছিল। মঙ্গলবার রাত থেকে ওই অংশ দিয়ে চৈতন্যপুর ১, ২ ও হাউর গ্রাম পঞ্চায়েতের বিভিন্ন গ্রামে জল ঢুকে রাস্তাঘাট ডুবে গিয়েছে। বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুরের কংসাবতী জলাধার থেকে দু’দিনে দু’দফায় জল ছাড়া হল। ফলে মঙ্গলবার রাত থেকেই ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকায় জল ঢুকতে শুরু করেছে। বুধবারও বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার সঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুরে দফায় দফায় ভারী বৃষ্টি হয়েছে। আর বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ায় ভারী বৃষ্টি হলেই শীলাবতী নদী হয়ে সেই জল ঘাটালে ঢোকে। তাতে জলমগ্ন হয়ে পড়ে মহকুমার বিভিন্ন এলাকা। প্রশাসন সূত্রের খবর, কংসাবতী জলাধার থেকে ছাড়া জল ঘাটালে ঢুকতে এখনও দু’দিন সময় লাগবে। ফলে বৃহস্পতিবার রাত থেকে ঘাটাল ব্লকের দশটি পঞ্চায়েত এলাকা-সহ দাসপুর ১ ও চন্দ্রকোনা ১ ও ২ ব্লকের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হবে বলে আশঙ্কা। |
জলমগ্ন: জল ভেঙে পথ চলা তমলুক পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে। |
মহকুমাশাসক অংশুমান আধিকারীর আশঙ্কা, “বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এলাকা জলমগ্ন হবেই।” বুধবারই জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের ৫০ জনের একটি টিম ঘাটালে পৌঁছেছে। তাঁদের সঙ্গে রয়েছে একাধিক বোট-সহ সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা। প্রশাসন সূত্রে খবর, প্রায় ২০টি নৌকা মজুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও শুকনো খাবার, ত্রিপলও মজুত করা হয়েছে। এ দিকে মঙ্গলবার রাত থেকেই চন্দ্রকোনা ১ ব্লকের একাধিক এলাকা নতুন করে জলমগ্ন হয়েছে। জল উঠেছে ঘাটাল-চন্দ্রকোনা রোড সড়কের উপর মনসাতলা চাতালে। এর জেরে বৃহস্পতিবার থেকে ওই সড়কে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা। জল ঢুকছে ঘাটাল শহরের একাধিক ওয়ার্ডেও।
তিন দিনের নাগাড়ে বৃষ্টির ফলে মঙ্গলবার ঝাড়খণ্ডের সুবর্ণরেখার জলাধার থেকে এক লক্ষ আশি হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছিল। আর বুধবার আরও প্রায় তিন লক্ষ কিউসেক জল ছাড়ার ফলে পশ্চিম মেদিনীপুরের সুবর্ণরেখা তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে সুবর্ণরেখা, ডুলুং ও কংসাবতী নদীতে জল বইছে বিপদসীমার উপর দিয়ে। সুবর্ণরেখার জল এবং টানা বৃষ্টিতে ডুলুং নদীর জল একাকার হয়ে সাঁকরাইল ব্লকের প্রায় ৩৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে জলবন্দি করে ফেলেছে। সাঁকরাইল ব্লকের ডুলুং নদীর তীরবর্তী আঁধারি গ্রাম পঞ্চায়েতের আস্তি, বৈঞ্চা, শালতুরিয়া, শালবনি এবং রগড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের তেলকন্দ গ্রামগুলির সঙ্গে সাঁকরাইলের ব্লক-সদর রোহিনী এবং মহকুমা সদর ঝাড়গ্রামের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়েছে। প্রশাসনের হিসেবে সাঁকরাইল ব্লকের প্রায় হাজার দু’য়েক মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। সুবর্ণরেখা তীরবর্তী গোপীবল্লভপুর ১, গোপীবল্লভপুর ২ এবং নয়াগ্রাম ব্লকের কয়েকটি গ্রাম জলমগ্ন হয়েছে। গোপীবল্লভপুর ১ ব্লকের সাতমা গ্রাম পঞ্চায়েতের ডোমপাড়া, অমরদা গ্রাম পঞ্চায়েতের চাঁপাশোল, জানাঘাঁটি এবং শাসড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের করবনিয়া ও আসনবনি গ্রামে সুবর্ণরেখার জল ঢুকতে শুরু করেছে। ডোমপাড়ার একশো বাসিন্দাকে অন্যত্র সরানো হয়েছে। গোপীবল্লভপুর-২ ব্লকের চর্চিতা, কুলিয়ানা ও পেটবিন্ধি অঞ্চলের ৬টি গ্রামে জল ঢুকেছে। নয়াগ্রাম ব্লকের মলম ও বড়খাঁকড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ঝাড়গ্রাম মহকুমার ৮টি ব্লকে একশোরও বেশি মাটির বাড়ি ভেঙে পড়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কমপক্ষে সাড়ে চারশো মাটির বাড়ি। |
ঘাটাল-চন্দ্রকোনা সড়কে মনসাতলা চাতালে বিপজ্জনক যাত্রা। |
জলমগ্ন হয়েছে কাঁথি মহকুমার খেজুরি ও রামনগরের বেশ কিছু উপকূলবর্তী এলাকাও। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি। মৎস্য দফতর থেকে উপকূলের মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। মহকুমার ৪০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩৪২টি মৌজায় ৭৬৬৫ হেক্টর আমন ধানের জমি জলমগ্ন হয়ে পড়েছে বলে কাঁথি মহকুমার কৃষি দফতরের সহ-অধিকর্তা অশোক শীট জানিয়েছেন। রামনগর ২ ব্লকের কালিন্দী ও মৈতনা অঞ্চলের নীচু এলাকা সমুদ্র ও খালের জলে জলমগ্ন হয়েছে। রামনগর ২ ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক সুকান্ত সাহা জানান, “ইতিমধ্যেই ওই দুটি অঞ্চলের ১১টি বাড়ি সম্পূর্ণ এবং ৪৩টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ব্লক প্রশাসন থেকে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।’’ খেজুরি ২ ব্লকের উপকূলবর্তী কাদিরাবাদচর, সাহেবনগর, কাউখালি-সহ বেশ কিছু গ্রামে সমুদ্রের জল ঢোকায় কৃষিজমি জলমগ্ন হয়েছে।
নিম্নচাপের জেরে টানা চার দিন বৃষ্টিতে জলমগ্ন এগরা মহকুমার অনেক কৃষিজমি। সেচ দফতরের কাঁথি বিভাগের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র স্বপনকুমার পণ্ডিত জানান, পটাশপুর ১ ব্লকের বাড়মোক্ষল গ্রামে কেলেঘাই নদীর পাড়ে বাঁধে তিন জায়গায় প্রায় ১৫০মিটার অংশে ধস নেমেছে। বৃষ্টি কমলেই বাঁধের ওই অংশ মেরামত করা হবে। তিনি বলেন, “ঝাড়খণ্ডের গালুডি ব্যারাজ থেকে ২.৫ লক্ষ কিউসেক জল ছাড়ার ফলে সুবর্ণরেখা নদীর জল বুধবার সন্ধ্যায় প্রাথমিক বিপদসীমা ছুঁয়েছে।” এগরার মহকুমাশাসক অসীমকুমার বিশ্বাস জানান, “টানা বৃষ্টিতে মহকুমার ৩৯৩টি কাঁচাবাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা ৩২৭৭।”
|
—নিজস্ব চিত্র |
পুরনো খবর: টানা বৃষ্টি আর ব্যারাজের জলে ভাসল দুই জেলা |
|
|
|
|
|