তত্ত্ব আর তার প্রয়োগ যাতে মানুষের কল্যাণ করতে পারে, সে জন্য মানুষের সঙ্গে কথা বলাটাকে
অমর্ত্য সেন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। যাকে বলে পাবলিক ডায়ালগ। এতে গণতন্ত্র পরিপক্ব হয়। |
খুবই সমস্যার সৃষ্টি করেছেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। বেশ তো ছিলেন নোবেল পেয়ে। সনাতন ভারতীয় ধীশক্তির ধার প্রমাণ করছিলেন। নালন্দার দায়িত্ব নিয়ে এ দেশের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। গরিব কী করে ভাল থাকে, লেখাপড়া শেখে, তার পথ বলে দিচ্ছিলেন। কেন ভাল থাকে না, সেটাও বলছিলেন। এ পর্যন্ত সহ্য করা গিয়েছে। প্রয়োজনমত এবং ঠিক ঠিক ভাবে রাজনীতির মানুষরাই তো অমর্ত্যচিন্তার আলো সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিয়েছেন।
কিন্তু গোল বাধল সেই দিন, যে দিন তিনি বাকি সবার মতো শুধু উঁচু আসনে বসে আঁক না কষে উঁকিঝুঁকি দিলেন, ‘ও পাড়ার’ দ্বারে প্রবেশ করার তাগিদ নিয়ে। বলতে শুরু করলেন, দেশের মানুষকে আরও ভাল রাখা যায়। যতটা ভাল তারা আছে, তার চেয়েও ভাল। এহ বাহ্য। তিনি বললেন, সরকারেরই দায়িত্ব তাদের আরও ভাল রাখা। সরকারকেই বোঝাতে হবে দেশের নানা খানাখন্দ-আঁধারির জায়গাগুলোকে। বাজার তার চিরক্ষুধাময় আত্মা নিয়ে আরও আলোলিত করুক বিলাসব্যসন, শিল্প আর বাণিজ্যকে। কিন্তু অসম বিকাশের মোহময় ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে আছে যে গ্রামীণ জীবন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তাদের সরকারই যথাযথ ভাবে পরিশীলন করুক, বাজার হোক তার সহায়। দার্শনিক কোথায় এসে যেন মানুষ হয়ে যান, সমাজজীবনের নানান গুণগত খাঁজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া পথ খোঁজেন। এ হয়তো আসলে সৃষ্টিশীলতার অমোঘ তাড়না। |
আর এখানেই অনেকের প্রশ্ন: অ্যাকাডেমিক কখনও অ্যাক্টিভিস্ট হয় নাকি? কিন্তু অমর্ত্য সেনরা এটা করেই থাকেন। চেনা গণ্ডি ভাঙেন, নতুন পথ তৈরি করেন, আর তার মধ্য দিয়েই কৃষ্টি আর সৃষ্টির এগিয়ে চলার খবর দেন, সমাজ এবং অর্থনীতি কোন দিশায় পথ হাঁটবে সেই নির্দেশ দেন। তত্ত্ব আর তার প্রয়োগের ক্ষেত্রটাকে কী করে মানুষের কল্যাণে আরও কাজে লাগানো যায়, সেই লক্ষ্যে মানুষের সঙ্গে কথা বলাটাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। যাকে বলে পাবলিক ডায়ালগ। এতে গণতন্ত্র পরিপক্ব হয়। শিশুর এক বিশেষ ভাষা থাকে, যা বোঝে শিশুর মা। অত্যন্ত ক্ষমতাবান শিশু চিকিৎসকও সে ভাষা ধার করেন মায়ের থেকে। মানুষের সঙ্গে নিরন্তর আলাপ করা, ধৈর্য নিয়ে তাঁদের কথা শোনা আর প্রবল ধীশক্তি সহকারে মুক্তমনে তার ভাল-মন্দ বিশ্লেষণ করা এই পদ্ধতিতেই অধ্যাপক সেনের সমাজবীক্ষা এগিয়ে চলে। প্রাতিষ্ঠানিক জপতপ আর তুকতাকের বাইরে মানবসাধনা সেন-তত্ত্বের অন্যতম ভিত্তি।
যে বিতর্ক লাগু আছে তার আলোচনায় আমরা একটা ভীষণ জরুরি বিষয়ের আলোচনা প্রায় করছি না। চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের ভাবনা উৎসারিত হয় তাঁর মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের কথোপকথন থেকে বেরিয়ে আসা দৃশ্যপটের বিশ্লেষণের সমন্বয়ে। এতে অবশ্যই ‘পক্ষপাত’ থাকে, যা আবশ্যিক মানসিক গুণাবলির অন্যতম। আর সৃষ্টিশীল হওয়ার জন্য লাগে ছটফটানি সহিষ্ণু কিন্তু অধৈর্য। অধ্যাপক সেনের সঙ্গে বাকিদের তফাত অনেকটাই গড়ে দেয় তাঁর ভাবনা এবং দর্শনের এই দিকগুলো।
বাজার না সরকার মানুষের বেশি ভাল কে করে, তার বিতর্ক বলে এটাকে চিহ্নিত করা বোধ হয় অতিসরলীকরণ। প্রচলিত বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থায় বাজারের গুরুত্বকে অধ্যাপক সেন অস্বীকার করছেন ব্যাপারটা বোধ হয় এ-রকম না। সমাজ গঠনে ও পরিচালনায় কার কী ভূমিকা তা ঠিক করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের প্রশ্নটাই জরুরি। অভিজ্ঞতা ও গবেষণা বলে, সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে থাকা অদ্ভুত স্থিরতা, বস্তুত স্থবিরতা, সৃষ্টিশীলতাকে গ্রাস করে, গতানুগতিকতাকে পাথেয় করে। চিন্তা এবং সংস্কৃতিতে অর্ধক্ষম বা নিতান্তই নিম্নমানের মানুষদের সরকারি ব্যবস্থা জায়গা দেয়। তাঁরা প্রতিভাবান এবং অগ্রবর্তী নতুন ভাবনার মানুষদের কোটরাবদ্ধ করতে পারেন। তবুও সরকারের দায় থাকে বেশি মানুষের ভাল থাকার প্রতি। বাজারের সে দায় থাকে না। কাজেই বাজারের শ্রীবৃদ্ধি হলেই সমাজের আঁধার চলে যাবে এই তত্ত্বে অধ্যাপক সেন সহমত নন।
ভারতের সমাজচিত্রের এখনকার অবস্থায় চার দিকে নানা খানাখন্দ, ধুলো-ধোঁয়া। এ সব মেরামতির দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হয়। বাজার তার সহায়ক হতে পারে। কিন্তু এই ক্ষেত্রগুলিকে বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে যেখানে এখন অর্ধগ্রহণ সেখানে পূর্ণগ্রহণ হবে; আলো জ্বলবে আরও উজ্জ্বল হয়ে সেখানে, যেখানে এখনই আলো আছে। ‘গ্রোথ আনলিমিটেড’ বলে একটা প্রবাদ বাজারের প্রবক্তাদের তাড়িত করে। আর এই স্লোগানের ক্ষেত্র হিসাবে এবং শিল্পসৃষ্টির সম্ভাবনার নিরিখে বেড়ে ওঠার স্পেস এখানে বেশি। অমর্ত্য সেনের চিন্তা সেখানেই। এমনটা চললে সমাজের ‘ফাইলেরিয়াল গ্রোথ’ হতে পারে। তাই উচ্চারিত হয় তাঁর সতর্কবাণী। যেন যক্ষপুরীতে রঞ্জনের কণ্ঠস্বর।
ফাগুলালেরা অবশ্য বিচলিত। চার পাশে কেমন যেন একটা চাপা স্নেহসিক্ত কণ্ঠস্বর: সেন সাহেব এতটা না করলেই পারতেন বোধ হয়। ‘অ্যাকাডেমিক’-এর রাজার আসন ছেড়ে রাজপথে এসে পড়া অমর্ত্যকে নিয়ে তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যেও কেমন জানি ফিসফাস। এতটা র্যাডিকাল! বোধ হয় একটু আগেই থামা যেত, ইত্যাদি।
সৃষ্টি বাঁধ ভাঙে, পথ গড়ে, বেড়াজাল ছিঁড়ে ফেলে। অতএব ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাক্টিভিজ্ম’-এর এই যে নতুন পথ আমরা দেখছি আর প্রতিষ্ঠিত জননায়করা যা দেখে ত্রস্ত ও ক্রুদ্ধ, তা কিন্তু দেশের গণতান্ত্রিক ভাবনাকে পরিশীলিত করতে পারে। পারে কবন্ধ দশা থেকে মুক্তি দিতে। বিতর্ক আরও উঠুক। অন্তত হাওয়া তো বইছে, অনেক গুমোটের মাঝে।
|