প্রবন্ধ ১...
কেন আমেরিকা ইরানের চক্ষুশূল
বশেষে স্বীকারোক্তি মিলল। ইরানের রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে যাঁরা নাড়াচাড়া করেন তাঁদের অজানা ছিল না যে, সে দেশের বিপুল তেল সম্পদের উপর দখল রাখার জন্য সেখানকার গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ মোসাদ্দেগকে ১৯৫৩ সালের ১৯ অগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হটিয়ে দেওয়ার পিছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের দুই গুপ্তচর সংস্থা সি আই এ এবং এম আই ৬-এর সরাসরি হাত ছিল। এ বিষয়ে যে সব নথি ও তথ্য এত দিন গোপন রাখা ছিল, ওই অভ্যুত্থানের ষাট বছর পূর্তির দিন সি আই এ তা বহুলাংশে ‘ডিক্লাসিফাই’ করেছে, অর্থাৎ জনসমক্ষে এনেছে। ২০০০ সালে এরই কিছু অংশ এক মার্কিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। কী ভাবে এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হয়েছিল, তার কিছুটা আভাস আমরা তখন পেয়েছিলাম। কিন্তু সোমবার, ১৯ অগস্ট প্রকাশিত নথির মাধ্যমে আমেরিকা এই প্রথম সরকারি ভাবে স্বীকার করল যে তারা এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল।

বিশ শতকের প্রথম থেকে উপর্যুপরি রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে ইরানের শাসক শাহ-এর ক্ষমতা খর্ব হয়ে মজলিস বা সংসদ ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। সংসদীয় গণতন্ত্রের রাস্তায় মোসাদ্দেগকে মজলিস ১৯৫১ সালের ২৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে। নিজের দল ছাড়া আরও কয়েকটি বাম দলের সমর্থন ছিল তাঁর পক্ষে। ব্যক্তি হিসেবে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে তাঁর নানা মিল আছে। পণ্ডিত, বাগ্মী, লেখক, আইনজীবী ও সফল সাংসদ মোসাদ্দেগ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ইরানের প্রাচীন সামন্ত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে ভূমি সংস্কার শুরু করেন, দাস-শ্রমিক প্রথা নিষিদ্ধ করেন ও চালু করেন দরিদ্রদের জন্য নানান সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা। আরও দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেন তিনি। এক, শাহের ক্ষমতা আরও সীমিত করা এবং দুই, ইরানের তেল সম্পদের জাতীয়করণ।
মার্কিন দূতাবাসের সামনে। ইসলামি বিপ্লবের ২৫ বছর। তেহরান, ২০০৪। গেটি ইমেজেস
বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ইরানে বিপুল তেল-ভাণ্ডারের সন্ধান পেয়ে সেই সময়ে ওই অঞ্চলের সর্ববৃহৎ ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন একটি কোম্পানি গঠন করে সেই তেল সম্পদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৩৩ সালে শাহের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে নামমাত্র রয়ালটি-র বিনিময়ে সেই ব্রিটিশ কোম্পানি ষাট বছরের জন্য ইরানের তেল সম্পদের অধিকার নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম এশিয়া জুড়ে যে প্রবল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠছে, ইরানেও তার প্রভাব পড়ে। এক দিকে এই জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ আর অন্য দিকে বামপন্থী দলগুলির দাবিতে দেশ জুড়ে ওই অসম চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। এই বিতর্ক ক্রমেই বড় আকার ধারণ করে এবং ১৯৫৩ সালের মার্চে মজলিস বা সংসদ ওই ব্রিটিশ তেল কোম্পানির জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সংসদই পরের মাসে মোসাদ্দেগকে প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত করে। মোসাদ্দেগ দ্রুত সেই তেল কোম্পানির জাতীয়করণের প্রস্তাব কার্যকর করেন। এর থেকেই তাঁর সঙ্গে ব্রিটেনের সংঘাতের সূত্রপাত।
ইরানকে শিক্ষা দিতে ব্রিটেন তার বিরুদ্ধে কার্যত এক অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তোলে। আন্তর্জাতিক বাজারে ইরানের তেল বিক্রি বন্ধ করতে ব্রিটেন তার প্রভাব খাটায় এবং ইরান থেকে তাদের সব প্রযুক্তিবিদকে প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ইরানের তেল উৎপাদন প্রবল মার খায় ও তেল থেকে আয় ভয়াবহ ভাবে কমে আসে। এই সঙ্গে মোসাদ্দেগকে বরখাস্ত করার জন্য ব্রিটেন শাহ রেজা পহলাভিকে চাপ দিতে থাকে। শাহ তাঁকে বরখাস্ত করলেও ব্যাপক গণ-বিক্ষোভের মুখে পড়ে পুনর্বহাল করতে বাধ্য হন। এর পরেই মোসাদ্দেগ ব্রিটেনকে ইরানের শত্রু ঘোষণা করে সে দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এই প্রেক্ষাপটে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোসাদ্দেগকে হটিয়ে শাহকে শক্তিশালী করার প্রস্তাব নিয়ে ব্রিটেন যায় আমেরিকার কাছে। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান সে প্রস্তাব খারিজ করেন। ১৯৫২ সালে আইজেনহাওয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ব্রিটেন আবার একই প্রস্তাব নিয়ে যায়। এর সঙ্গে ভয় দেখায়, ইরানে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব বাড়ছে, অচিরেই সে দেশ সোভিয়েত কুক্ষিগত হয়ে পড়বে। কাজ হয়। কমিউনিস্ট জুজুর ভয়ে সদাসন্ত্রস্ত আমেরিকা রাজি হয় অভ্যুত্থান ঘটাতে।
সদ্য প্রকাশিত নথিগুলিতে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে শেষ চূড়ান্ত চার দিনের প্রতি ঘণ্টার ঘটনাবলির এক রোমহর্ষক বিবরণ মিলছে। জানা যাচ্ছে যে, মার্কিন প্রশাসন এই অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য দশ লক্ষ ডলার বরাদ্দ করেছিল। এই অর্থের বেশির ভাগ ব্যয় হয় শাহ-পন্থী নেতা, পুরনো সামান্ত্রতান্ত্রিক জমিদার আর মোসাদ্দেগ-বিরোধী নেতাদের ঘুষ দেওয়ার জন্য। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাছা হয় মোসাদ্দেগের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগী মন্ত্রী জেনারেল ফাজ্লোল্লাহ্ জাহেদিকে। তেহরানের কুখ্যাত গুন্ডা শাবান জাফেরি যাতে তার দলবল নিয়ে ও আরও লোক জড়ো করে রাস্তায় বিক্ষোভ দেখাতে পারে তার জন্য তাকে অর্থ দেওয়া হয়।
সি আই এ এবং এম আই ৬-এর গুপ্তচররা এই পরিকল্পনা শুরু করেন ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে, সাইপ্রাস-এর নিকোসিয়াতে। ১৯৫৩-র ১০ জুন পরিকল্পনা পাকা করে তাঁরা দুই দেশের নেতাদের কাছে অনুমতির জন্য পাঠান। ১১ জুলাই দুই দেশের বিদেশমন্ত্রী অনুমতি দেন আর খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুমতি মেলে জুলাই-এর মাঝামাঝি। গোটা পরিকল্পনার কার্যভার দেওয়া হয় সি আই এ-র মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা ডিভিশন-এর প্রধান, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিয়োডোর রুজভেল্ট-এর নাতি, কারমিট রুজভেল্টকে।
এই গোটা পরিকল্পনার একটি জরুরি ছক ছিল শাহকে দিয়ে দুটি ফরমান সই করানো। একটিতে তিনি মোসাদ্দেগকে বরখাস্ত করবেন আর অন্যটিতে থাকবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জেনারেল জাহেদির নিয়োগপত্র। কিন্তু শাহ দ্বিধাগ্রস্ততায় ভুগতেন। তাঁকে বোঝানোর জন্য ইউরোপ থেকে তাঁর বোন রাজকুমারী আশরাফ পহলাভিকে তেহরানে আনা হয়। নিয়ে আসা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের প্রাক্তন মার্কিন সেনাপ্রধান ও শাহের আস্থাভাজন জেনারেল শোয়ার্ট্জ্কফকে। এতেও কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত রুজভেল্ট নিজে শাহের সঙ্গে দেখা করেন। ১৯৫৩-র ১৫ অগস্ট শাহ ফরমান দুটিতে সই করেন।
স্থির হয়, ১৬ অগস্ট শাহ-অনুগামী কিছু সেনা অফিসার ও সেনানী মোসাদ্দেগকে অপহরণ করবে এবং শাহের ফরমান নিয়ে ক্ষমতা দখল করবেন জেনারেল জাহেদি। কিন্তু সরকার এই ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে শহরে সেনা নিয়োগ করে। মার্কিন ও ব্রিটিশ এজেন্টরা ধরে নেয় যে তাদের সব পরিকল্পনা ভন্ডুল হতে বসেছে। ইতিমধ্যে শাহ দেশে ছেড়ে পালিয়েছেন বাগদাদে, আর সি আই এ জেনারেল জাহিদকে তাদের একটি গোপন ডেরায় লুকিয়ে রেখেছে। পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেছে ভেবে উপরতলা থেকে এজেন্টদের ইরান ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে ভেবে সরকার ১৮ অগস্টের পর রাস্তা থেকে সেনা তুলে নেয়। রুজভেল্ট ও তাঁর দলবল ১৯ তারিখ ভোর থেকে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
শাহ-অনুগামী ভাড়াটে গুন্ডারা তেহরানের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করে এবং শহরে বিশৃঙ্খলা নেমে আসে। সেই সুযোগে শাহ-পন্থী সেনাদের সাহায্যে সি আই এ জেনারেল জাহেদিকে গোপন ডেরা থেকে বের করে রেডিয়ো ও সেনা সদর দফতর দখল করে। শাহের ফরমানের জোরে জাহেদি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন। মোসাদ্দেগের বাড়ি জ্বালানো হয়, তাঁর অনুগামীরা গ্রেফতার হন। এর পরেই ওয়াশিংটন ইরানের সরকারকে বিপুল আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। সরকারি কর্মীদের মাইনে দিয়ে তাঁদের মন জয় করতে অভ্যুত্থানের দু’দিনের ভিতর সি আই এ গোপনে জাহেদিকে ৫০ লক্ষ ডলার দেয়।
সদ্য প্রকাশিত এই সব নথি সংকলিত করেছিলেন এই ষড়যন্ত্রের অন্যতম অংশীদার ডোনাল্ড উইলবার। ইরান-বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে এই লেখক ও গবেষক সি আই এ-র চর হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন।
আমেরিকার আইন অনুযায়ী এই সব তথ্য আরও আগে প্রকাশিত হওয়ার কথা। ২০০০ সালে সংবাদপত্রে কিছু খবর ফাঁস হওয়ার পরেও সি আই এ বাকি তথ্য প্রকাশে নারাজ ছিল। অবশেষে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল সিকিয়োরিটি আর্কাইভস বিভাগ আইনের পথে গিয়ে এই সব তথ্য প্রকাশ করতে সরকারকে বাধ্য করেছে।
ব্রিটেন এখনও এই অভ্যুত্থানে তার ভূমিকা অস্বীকার করে। এই সব নথিতে অবশ্য দেখা যাচ্ছে যে, অপারেশন শেষ হওয়ার পরে রুজভেল্ট লন্ডনে গিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যর উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছ থেকে প্রভূত প্রশংসা পান।
অভ্যুত্থানের পর অচিরেই শাহ দেশে ফিরে আসেন ও কঠোর হাতে দেশ চালানোর ভার নেন। মোসাদ্দেগের অনুগামীদের চরম অত্যাচারের পর জেলে পাঠানো হয়। বিদেশমন্ত্রী ও মোসাদ্দেগের অতি ঘনিষ্ঠ হোসেন ফাতেমিকে পাঠানো হয় ফায়ারিং স্কোয়াড-এর সামনে। ‘বিচার’-এর পর মোসাদ্দেগ সারা জীবনের জন্য গৃহবন্দি হন। ১৯৬৭-র মার্চে তাঁর জীবনাবসান হলেও তাঁর দীর্ঘ ছায়া শাহ ও আমেরিকার পিছু ছাড়েনি। যদিও ইসলামপন্থীদের সঙ্গে মোসাদ্দেগের সম্পর্ক ভাল ছিল না, তবু ১৯৭৯ সালে তাঁকে স্মরণ করেই শাহের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ইরানের মানুষ ইসলামপন্থীদের নেতৃত্বে শাহকে দেশ ছাড়া করে এবং মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালিয়ে সেটি দখল করে ৫২ জন মার্কিনি কূটনীতিক ও অন্যান্য কর্মীকে ৪৪৪ দিন আটক করে রাখে। আমেরিকার প্রতি যে বিদ্বেষ ১৯৫৩’য় সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রভাব আজও ওই অঞ্চলের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে চলেছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.