রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী অন্তত একটি ভাল কাজ করিয়াছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন, বিহারের ধমারাঘাট স্টেশনে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পিছনে রাজ্য প্রশাসনের পাশাপাশি রেলের বিভিন্ন স্তরের আধিকারিক ও কর্মীদের দায় আছে। সচরাচর এই ধরনের ঘটনার পরে মন্ত্রী বা অফিসাররা রকমারি কূটকৌশলের আশ্রয় লইয়া থাকেন, যাহা প্রকৃতপক্ষে তঞ্চকতা ভিন্ন কিছু নহে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন আড়াল রাখিবার বিশেষ সুযোগ ছিল না, ঘটনাটির কার্যকারণসূত্র স্বপ্রকাশ ছিল। তবুও, স্পষ্টভাষণ সতত শ্রেয়। মন্ত্রিবর আশ্বাস দিয়াছেন, এই ঘটনা হইতে শিক্ষা গ্রহণ করিয়া প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে, যাহাতে ভবিষ্যতে এমন বিপদ এড়ানো যায়। জনস্মৃতি ক্ষণস্থায়ী। তথ্য ও সংবাদের এই মহাবিস্ফোরণের যুগে সেই ক্ষণিকতা বহুগুণ বাড়িয়াছে। অধীরবাবু যদি সেই ভরসায় আশ্বাস বিতরণ করিয়া থাকেন, তবে বুঝিতে হইবে, তাঁহার স্পষ্টভাষণ কৌশলমাত্র। কিন্তু রাজনীতিকের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।
ধমারাঘাট স্টেশনে যে অব্যবস্থার চিত্রটি উদ্ঘাটিত, তাহা অন্য অনেক স্টেশনেই সমান বাস্তব। এবং অব্যবস্থা স্টেশনে সীমিত নহে, অরক্ষিত লেভেল-ক্রসিং বা অচল সিগনাল সহ বিবিধ সমস্যা বিস্তীর্ণ রেলপথ জুড়িয়া অগণিত স্থানে রহিয়াছে। তাহার সহিত যুক্ত রহিয়াছে কর্মীর অভাব, অদক্ষতা এবং কর্তব্যে অবহেলা। সুতরাং ‘সংশোধন করিব’ বলিলে কিছুই হইবে না, সংশোধনের একটি সামগ্রিক উদ্যোগ লইতে হইবে। পরিকাঠামো যেখানে নাই, সেখানে তৈয়ারি করা দরকার। কিন্তু, ‘যুদ্ধকালীন উদ্যোগ’ লইলেও, তাহা সময়সাপেক্ষ। দুর্ঘটনা নিবারণের জন্য সতর্ক নজরদারি জরুরি। ধমারাঘাট স্টেশনের কর্মীরা সতর্ক থাকিলে এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে সবুজ সংকেত দেওয়া হইত না। নজরদারির নির্দিষ্ট কিছু কৌশল আছে, যাহা প্রয়োগ করিলে এই সতর্কতা ব্যক্তির উপর ছাড়িয়া দিলে ‘মানবিক’ ভুলের সম্ভাবনা অনেক কমে। বিমান পরিবহণ বা শল্যচিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে, যেখানে একটি ছোট ভুলের পরিণাম মারাত্মক হইতে পারে, এই ধরনের নানা কৌশল ব্যবহার করা হয়। শুধু ‘চেকলিস্ট’ ব্যবহার করিয়া কত ভয়াবহ দুর্ঘটনা এড়ানো গিয়াছে, তাহার বহু দৃষ্টান্ত আছে, প্রবাসী ভারতীয় শল্যচিকিৎসক অতুল গাওয়ান্ডে এই বিষয়ে মূল্যবান ও জনপ্রিয় গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন, অধীরবাবু ও তাঁহার অফিসাররা পড়িয়া দেখিতে পারেন, উপকার পাইবেন।
যাত্রীদের সতর্কতাও কম জরুরি নহে। বিহারের ঘটনাটিতে যাত্রীরা রেললাইন ধরিয়া চলিতে ‘বাধ্য’ হইয়াছিলেন, এ কথা অস্বীকার করা কঠিন। কিন্তু প্রশ্ন যেখানে জীবন-মৃত্যুর, সেখানে ‘বাধ্য’ হইলেও ঝুঁকি নেওয়া বিধেয় নহে। বস্তুত, এ দেশে যাত্রী তথা সাধারণ মানুষের সতর্কতাবোধের বিপুল ঘাটতি। শহরের রাস্তায় সম্পূর্ণ অসতর্ক পদচারণার রীতি মজ্জাগত। হেলমেট ছাড়া বাইক চালানোর দৃশ্য অতি সুলভ। যত্রতত্র অগণিত মানুষ নিয়মিত রেললাইন ধরিয়া চলাচল করেন, অকাতরে পারাপার করেন, যেন উহাই পায়ে হাঁটিবার জন্য নির্ধারিত পথ! ‘কী করিব, পথ নাই’ বলিয়া এই বিপজ্জনক কু-অভ্যাসের অজুহাত দেওয়া চলে। কিন্তু অজুহাত আর যুক্তি এক নহে। অজুহাত বিপদ হইতে বাঁচাইতেও পারে না। সচেতনতা আপনাআপনি আসিবে না, সে জন্য যথেষ্ট প্রচার দরকার। প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থারও। কঠোরতা জনপ্রিয় হইবে না, কিন্তু তাহাতে জন-প্রাণ বাঁচিবে। |