ওড়িশায় বেদান্ত সংস্থার অ্যালুমিনিয়াম কারখানার জন্য নিয়মগিরি পাহাড় হইতে বক্সাইট সংগ্রহের জন্য স্থানীয় গ্রামবাসীদের অনুমতি লইতে হইবে, সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ পালনের জন্য নির্ধারিত বারোটি গ্রামসভার সর্বশেষটি সোমবার সম্পন্ন হইয়াছে, প্রত্যেকটি সভা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইয়া দিয়াছে, নিয়মগিরিতে হাত দেওয়া চলিবে না। ইতিমধ্যেই সংস্থাটি প্রয়োজনীয় বক্সাইট অন্যত্র সংগ্রহের চেষ্টা করিতেছে, ওড়িশা সরকারও সে জন্য সাহায্য করিতেছে। বিকল্প ব্যবস্থায় খরচ বাড়িলেও সংস্থার অ্যালুমিনিয়ম কারখানা বন্ধ হইবে, এমন আশঙ্কা কম। কিন্তু নিয়মগিরির আট-দশ হাজার আদিবাসী মানুষের এই ‘সফল’ প্রত্যাখ্যান পূর্বদৃষ্টান্ত হিসাবে তাৎপর্যপূর্ণ। পাহাড় হইতে বক্সাইট সংগ্রহের জন্য গ্রামবাসীদের অনুমতি লইতে হইবে এই নির্দেশ প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ ও জীবনযাত্রার উপর স্থানীয় মানুষের অধিকারের এক নূতন ধারণাকে স্বীকৃতি দেয়। এই অধিকারের ধারণাটি সম্ভবত অনুরূপ নানা ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হইবে, খনিজ, আরণ্যক বা অন্যান্য সম্পদ আহরণের জন্য স্থানীয় অধিবাসীদের অনুমোদনের প্রয়োজন হইবে, নিছক সরকারি অনুমোদনের জোরে আর সেই ‘অধিগ্রহণ’ সম্ভব হইবে না।
যে এবং যাহা যেখানে যেমন আছে, তাহাকে তেমনটি রাখিয়া শিল্পসভ্যতার বিকাশ সম্ভব নহে। সুতরাং স্থানীয় সমাজের অনুমোদনের উপর উন্নয়ন নির্ভর করিলে তাহার গতি এবং প্রসার ব্যাহত হইতেই পারে। কিন্তু সেই যুক্তিতে এই সামাজিক অনুমোদনের দাবি নাকচ করা যায় না। তাহা ন্যায্যতার দাবি। দীর্ঘদিনের জীবনযাপনের ভিত্তিতে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর স্থানীয় মানুষের যে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, গণতান্ত্রিক দেশে তাহাকে সম্মান করিতে হইবে। অরণ্য আইন সহ বিভিন্ন আইনে এ দেশে সেই অধিকার উত্তরোত্তর বিধিবদ্ধও হইয়াছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইনের গণ্ডির বাহিরেও রহিয়াছে বৃহত্তর নৈতিক অধিকার। অতীতে, স্বাধীনতার পরে বেশ কয়েক দশক, এই অধিকার যথেষ্ট মর্যাদা পায় নাই, উন্নয়নের স্বার্থে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বহু মানুষ উৎখাত হইয়াছে, তাঁহাদের সমাজজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হইয়াছে। তাহা অবিবেচনার ইতিহাস। শতাব্দী পালটাইয়াছে, গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়িয়াছে, আজ আর সেই অবিবেচনার স্থান নাই। উন্নয়নকে এখন বিবেচনাশীল হইতে হইবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ বিবেচনার পথ প্রশস্ত করিয়াছে।
সেই পথে অগ্রসর হইলে উন্নয়ন ‘বনাম’ পরিবেশের দ্বন্দ্ব নিরসনের উপায়ও মিলিতে পারে। জমি বা সম্পদের প্রয়োজনে যদি স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাইতেই হয়, তবে তাঁহাদের যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দেওয়া আবশ্যক। সেই ক্ষতিপূরণ নামমাত্র বা দায়সারা হইলে চলিবে না। সে জন্য প্রয়োজনে আইন বদলাইতে হইবে। নীতিও। যেমন খনিজ সম্পদের উপর সরকারের যে অধিকার বরাদ্দ হইয়াছে, তাহা নীতিগত ভাবে অযৌক্তিক। জমির মতোই খনিজের অধিকারও সংশ্লিষ্ট অধিবাসীদেরই হওয়া উচিত। সম্প্রতি একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ও এই পথেই আইন সংশোধনের অনুজ্ঞা দিয়াছে। সেই অধিকার মানিয়া লইলে ক্ষতিপূরণের মাত্রা বিপুল ভাবে বাড়িয়া যাইতে বাধ্য। কী ভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া বিধেয়, কী ভাবে তাহার দ্বারা স্থানীয় জনজীবনের যথার্থ উন্নতি সাধন সম্ভব, সে সকল প্রশ্ন নিশ্চয়ই বিচারসাপেক্ষ। সেই বিচারেও স্থানীয় অধিবাসীদের মতামত লওয়া জরুরি। কিন্তু প্রথম কথা, উন্নয়নের সমগ্র পদ্ধতিটিকে জনসমাজের অধিকার ও সক্রিয় যোগদানের ভিত্তিতে চালিত করা দরকার। তাহা হইলে উন্নয়নের নূতন ইতিহাস রচিত হইতে পারে। এই কারণেই নিয়মগিরির ঘটনাটি, আক্ষরিক অর্থেই, ঐতিহাসিক। |