ভোরের প্রথম আলো তখনও মাটি ছোঁয়নি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসের তিন শহরতলি আইন তারমা, জামালকা এবং জোবার বাসিন্দারা। সে ঘুম আর ভাঙল না। শ্বাসের সঙ্গে বিষাক্ত গ্যাস শরীরে ঢুকে প্রাণ কেড়ে নিল বহু বাসিন্দার। নিহতের সংখ্যা নিয়ে নানা মত থাকলেও সিরিয়ার অন্যতম প্রধান বিরোধী দলের দাবি, প্রাণ গিয়েছে অন্তত ১৩০০ জনের। নিহতের মধ্যে অগুনতি শিশু। তবে অন্তত একটা ব্যাপারে সকলেই একমত। নিছক অঘটন নয়, রীতিমতো ষড়যন্ত্র রয়েছে এই ‘গণহত্যার’ পিছনে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদের অনুগামী সেনারাই যার মূল চক্রী।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে দিন তিনেক আগে দামাস্কাসে এসে পৌঁছেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের এক বিশেষজ্ঞ দল। ১৯ মার্চ সিরিয়ায় বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে যে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছিল, তার তদন্তেই এসেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের উপস্থিতিতে এবং কার্যত তাঁদের নাকের ডগায় ফের রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের ‘দুঃসাহস’ আদৌ সিরিয়া সরকার বা সেনার পক্ষে দেখানো সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহে আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ। তবে আসাদ-বিরোধী তথা পশ্চিমী দুনিয়ার একাংশের বিশ্বাস, আসাদ-প্রশাসন সবই পারে। |
অসমর্থিত সূত্রের দাবি, বুধবার ভোর তিনটে নাগাদ বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাসভর্তি রকেট দামাস্কাসের ওই তিন শহরতলি এলাকায় আঘাত হানে। তার পর থেকেই শুরু হয় মৃত্যু মিছিল। দিনভর যার একের পর এক ছবি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রকাশ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কোনও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটা ঘরে অন্তত ৯০টি দেহ শোয়ানো। তাদের মধ্যে কয়েকটি দেহ কম্বলে মোড়া। আবার একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১৬ জন শিশু ও ৩ প্রাপ্তবয়স্কের সাদা চাদরে ঢাকা দেহ। স্থানীয় এক নার্স, বায়ান বেকার বললেন, “মৃতদেহের প্রত্যেকটিরই চোখ বিস্ফারিত, হাত-পা অসাড়, মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে।” চিকিৎসকদের দাবি, সাধারণত সারিন বা নার্ভ-গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই এমন উপসর্গ দেখা যায়। পাশাপাশি অন্য একটি মানবিক ছবিও দেখছে সিরিয়া। দেখছে, অস্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কী ভাবে ডাক্তার, নার্সদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে অসুস্থদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন সাধারণ মানুষই।
কিন্তু হঠাৎ এ বীভৎসতা কেন? স্থানীয়দের একাংশের মতে, দামাস্কাসের ওই তিন শহরতলি বেশ ক’মাস ধরেই আসাদ-বিরোধী মতাদর্শের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। সেখানে বড়সড় আঘাত হানতে এই হামলার ছক কষেছে আসাদপন্থী সেনা। একটি সংস্থার দাবি, বিষাক্ত গ্যাস ছড়ানো ছাড়াও ওই তিন এলাকায় ক্রমাগত বোমাবর্ষণ করে চলেছে যুদ্ধবিমান। তবে সেনার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ এই প্রথম নয়। বিরোধীরা আগেও বিষ গ্যাস ব্যবহারের অভিযোগ এনেছে সেনার বিরুদ্ধে। সব অভিযোগই উড়িয়ে দিয়েছে সরকার।
সিরিয়ার জাতীয় সংবাদ সংস্থার বয়ানে, “শহরতলিতে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের যে অভিযোগ এসেছে, তা ভুয়ো। আসলে রাষ্ট্রপুঞ্জের তদন্তে বাধা দিতেই এই প্রচেষ্টা।” কিন্তু তাতে কিছুতেই দমছেন না বিরোধীরা। আইন তারমা-র লোক্যাল কাউন্সিলের সদস্য খালেদ ওমর জানাচ্ছেন, স্থানীয় একটি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তত ৮০টি দেহ দেখেছেন তিনি। সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশন দাবি করেছে, এই হামলায় ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন সাড়ে ছ’শো মানুষ। এ রকম একাধিক বিরুদ্ধ মত এখন ওই তিন শহরতলির আনাচ-কানাচে। |
আমেরিকার বক্তব্য, সিরিয়ার যদি কিছু লুকোনোরই না থাকে, তা হলে তাদের অবিলম্বে রাষ্ট্রপুঞ্জের দলকে ঘটনাস্থলে যেতে দেওয়া উচিত। রাষ্ট্রপুঞ্জকে জরুরি ভিত্তিতে আজকের ঘটনার আলাদা তদন্ত করার আর্জি জানিয়েছে ওবামা প্রশাসন। হোয়াইট হাউসের প্রিন্সিপ্যাল ডেপুটি সেক্রেটারি জন আর্নেস্ট বলেছেন, “যে কোনও রকমের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের তীব্র নিন্দা করছে আমেরিকা। এর জন্য যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।” রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ আজই জরুরি বৈঠকে বসেছে।
সিরিয়ার মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিয়েছে, মৃতের সংখ্যা একশো। তবে তা বাড়তে পারে। কিন্তু আসাদ-সরকারের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি ওই
সংস্থা। অন্য দিকে, ঘটনাটি নিয়ে বিরোধীদের মতামত রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানোর কথা ঘোষণা করেছে ব্রিটেন। এর আগেও অবশ্য আমেরিকা-পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে সমর্থন জানিয়েছিল।
সিরিয়া সেই অল্প সংখ্যক দেশগুলির অন্তর্ভুক্ত, যারা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। আমেরিকা তথা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির আশঙ্কা, সারিন-সহ একাধিক বিষাক্ত গ্যাস লুকিয়ে রেখেছে সিরিয়া-প্রশাসন। বিরোধিতার মুখে পড়ে তার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা তাই ছিলই।
আশঙ্কা সত্যিও হল। বুধবার দামাস্কাসের শহরতলিতে নামল মৃত্যুমিছিল। অভিযোগ প্রমাণিত হোক বা না হোক, যে মৃত্যুমিছিলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দায় এড়াতে পারছে না আসাদ-সরকার।
|