এক সময়ে দামোদরকে বলা হত ‘দুঃখের নদ’। ফি বর্ষায় খেয়ালখুশিতে চারদিক ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া সেই জলস্রোতকে বেঁধেছিল বাঁধ। কিন্তু দুর্গাপুরের ডিভিসি ব্যারাজের জলধারণ ক্ষমতা যেভাবে নেমে গিয়েছে তাতে ভয়াবহ বন্যা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করছে খোদ প্রশাসন।
দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় ব্যারাজ লাগোয়া নদীখাতে বালি জমেছে, পলি জমেছে। জলধারণ ক্ষমতা নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। গোড়ায় জলধারণ ক্ষমতা ছিল প্রায় সাড়ে ৬ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। কিন্তু কেন্দ্রীয় জল কমিশনের হিসাবে বতর্মানে তা নেমে এসেছে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন কিউবিক মিটারে। ফলে তেমন বৃষ্টি হলে এবং তার জেরে ব্যারাজ বেশি জল ছাড়তে বাধ্য হলে নদ উপচে যেতেও বেশি সময় লাগবে না।
সত্যিই তেমনটা ঘটলে বর্ধমান, বাঁকুড়া এবং হুগলি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা ধুয়ে যেতে পারে। দেখা দেবে সেচের জলের আকালও। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ, যে অবিলম্বে ব্যারাজের সংস্কার চেয়ে সংসদে দরবারও করছেন বর্ধমান-দুর্গাপুরের সাংসদ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও চিঠি দিয়ে তাঁদের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। |
ডিভিসি-র ব্যারাজের সামনে কমেছে নদীখাতের গভীরতা, জমেছে পানাও। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম। |
এক সময়ে দামোদরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। ১৯৪৩ সালে বহু মানুষ মারা যান। হাজার-হাজার বাড়ি ভেসে যায়। নষ্ট হয় বিস্তীর্ণ এলাকার চাষজমি। এর পরেই তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে। বর্ধমান, বাঁকুড়া ও হুগলির নিম্ন দামোদর এলাকাকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে আমেরিকার টেনেসি ভ্যালি অথরিটির (টিভিএ) অনুকরণে একটি সংস্থা গড়ার পরামর্শ দেয় তারা। টিভিএ-র প্রবীণ বাস্তুকার ডব্লিউ এল ভুরডুইনকে ডেকে আনা হয়। সব দিক খতিয়ে দেখে ১৯৪৪ সালে তিনি বহুমুখী পরিকল্পনার কথা শোনান।
ভুরডুইনের মত ছিল, শুধু বন্যা নিয়ন্ত্রণই নয়, দামোদরের জল পরিকল্পিত ভাবে সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। সেই সম্ভাবনার বাস্তব রূপ দিতে পশ্চিমবঙ্গ ও তৎকালীন বিহার সরকারের সঙ্গে যৌথ ভাবে উদ্যোগী হয় সরকার। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি) গড়ে তোলা হয়। উপরে বরাকর নদের উপর তিলাইয়া ও মাইথন, দামোদরের উপরে তেনুঘাট ও পাঞ্চেত এবং কোনার নদীর উপর কোনার জলাধার গড়া হয়। ১৯৫৫ সালে এক মাত্র ব্যারাজটি তৈরি হয় দুর্গাপুরে। দামোদর-বরাকর অববাহিকায় প্রায় সাড়ে ১৯ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এই ব্যারাজের ‘ক্যাচমেন্ট এরিয়া’ বা জলধারণের এলাকা। ব্যারাজটি লম্বায় ৬৯২ মিটার। গেটের সংখ্যা ৩৪। এই ব্যারাজ তৈরির ফলে নিম্ন দামোদরে বন্যার আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়। পাশাপাশি খরিফ চাষে প্রায় ৮ লক্ষ একর, রবি চাষে ৪৫ হাজার একর এবং বোরো চাষে প্রায় ১ লক্ষ ৭২ হাজার একর জমিতে সেচের ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
ডিভিসি ব্যারাজ গড়ে ওঠার ফলে ব্যাপক ভাবে উপকৃত হয় দুর্গাপুর শহরও। শহরের পানীয় জলের প্রধান উৎস দামোদর। ব্যারাজ থেকে জল কিনে তা পরিশোধন করে তা নিজেদের এলাকায় সরবরাহ করে দুর্গাপুর পুরসভা, দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা (ডিএসপি) এবং দুর্গাপুর প্রজেক্টস লিমিটেড (ডিপিএল)। শিল্পাঞ্চলের সমস্ত কারখানায় প্রয়োজনীয় জল যায় দামোদর থেকেই। পানাগড়ে নির্মীয়মাণ সার কারখানায় জল নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরিরও কাজ চলছে ব্যারাজের উপরের দিকে। কিন্তু কত দিন সব কিছু ঠিকঠাক চলবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে ব্যারাজের জলধারণ ক্ষমতার ক্রমহ্রাসমানতা। পাড় থেকে অনেকখানি ঢেকেছে কচুরিপানায়।
এই পরিস্থিতিতে তাঁদের আশঙ্কার কথা সম্প্রতি কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী হরিশ রাওয়াতকে জানিয়েছেন বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রের সাংসদ সাইদুল হক। জমে থাকা বালি অবিলম্বে তোলার ব্যবস্থা করার আর্জিও জানানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সাংসদকে দেওয়া চিঠিতে স্বীকার করেছেন, জলধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় দুর্গাপুর ব্যারাজের পরিস্থিতি সত্যিই উদ্বেগজনক। তবে তিনি এ-ও উল্লেখ করেছেন যে, রাজ্য সরকার বালি তোলার কাজ করবে বলে জানিয়েছে। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে কেন্দ্রীয় সরকার। বুধবার সাংসদ বলেন, “দু’এক দিনের মধ্যেই রাজ্যের সেচমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে দ্রুত শুরু করার আর্জি জানাব।” |