ক্ষোভ বুঝেই কমছে ঘরবন্দি থাকার মেয়াদ
হাইকোর্ট এবং রাজ্য সরকারের চাপ তো আছেই। লাগাতার পাহাড়ের সকলকে ঘরবন্দি করে রাখার আন্দোলনের ডাক দিয়ে নিজের খাসতালুকেও ক্ষোভ এবং বিরক্তির আঁচ পেলেন বিমল গুরুঙ্গ। আর তা আন্দাজ করেই কার্যত পিছু হটলেন তিনি, আরও এক বার। রবিবার দুপুরে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সদর দফতরে সম-মনোভাবাপন্ন দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকের পরে জানিয়ে দেওয়া হল, ‘ঘরে বসে থাকবে জনতা’ স্লোগানে যে পাঁচ দিন কার্যত বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছিল আজ, সোমবার থেকে, তা কমিয়ে এক দিনে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হল। বদলে বাকি চার দিন মানুষকে পথে নেমে আন্দোলন করতে অনুরোধ করল গোর্খাল্যান্ড জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি।
মোর্চা সূত্রের বক্তব্য, এই সিদ্ধান্ত বদলকে পিছিয়ে যাওয়া বলে মনে করার কারণ নেই। এই এক পা পিছিয়ে আসাটা আন্দোলনেরই কৌশল। তাদের দাবি, মোর্চা এখনও আন্দোলন থেকে সরে আসেনি।
তবে মোর্চা সূত্রে যা-ই দাবি করা হোক, গুরুঙ্গ যে বিভিন্ন চাপে কিছুটা হলেও পিছু হটছেন, সেটা এ দিনের বৈঠকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। একে তো যৌথ মঞ্চ গঠনের এক দিনের মধ্যেই গোর্খা লিগ সেই জোট ছেড়ে যায়। বনধ যে তাদের পছন্দ নয়, তা জানিয়ে দেয় সিপিআরএম। এ দিন সমস্যা হয় বৈঠকের জায়গা নিয়েও। সিংমারিতে নিজেদের সদর দফতর ছাড়া সাধারণত দার্জিলিং জিমখানা ক্লাবে বৈঠক করে মোর্চা।
ঘরবন্দি থাকার ফতোয়া আপাতত শিথিল। তবু আশঙ্কা কাটেনি। তাই
আগামী দিনের জন্য রসদ জোগাড়ে পথে পাহাড়বাসী। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
এ দিনও সেখানেই বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শনিবার আরও যে ৬ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাহাড়ে এসেছে, তাদের দু’কোম্পানির জায়গা এখন জিমখানা ক্লাবেই। তাই এ দিন সিংমারিতে বৈঠক করতে হল গুরুঙ্গদের। মাথার উপরে গ্রেফতারের আশঙ্কা থাকায় সেই বৈঠকে গুরুঙ্গ, রোশন গিরি এবং এক বিধায়ক তিলক দেওয়ান ছাড়া মোর্চার আর কোনও শীর্ষ নেতা হাজিরও ছিলেন না। ছিলেন না বিধায়ক বিনয় তামাংও। পুলিশ মনে করছে, গ্রেফতারির আশঙ্কায় গা ঢাকা দিয়েছেন বিনয়।
এই চিন্তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আর এক আশঙ্কা। মোর্চা নেতাদের একাংশ মনে করছেন, আন্দোলনে যদি কোনও ভাবে হিংসা ঢুকে পড়ে, তা হলে তাকে কাজে লাগিয়ে এ দেশে অশান্তি বাঁধাতে নেমে পড়তে পারে একাধিক পড়শি দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠী। নেপাল সীমান্তবর্তী হওয়ায় দার্জিলিং বরাবরই কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এক বার সেই অশান্তি শুরু হলে তাতে দলের নেতা-কর্মীকে জড়িয়ে নতুন মামলা, ধরপাকড় হতে পারে। তখন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার লোক পাওয়াই কঠিন হবে। অগস্টের গোড়া থেকে এখনও পর্যন্ত দলের অন্তত ৫৫০ নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। আরও শতাধিক নেতা-কর্মীকে পুরানো মামলায় গ্রেফতারের জন্য তল্লাশি চলছে। এ দিন জিটিএ সদস্য প্রভা ছেত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। এই নিয়ে জিটিএ-র দশ জন সদস্য গ্রেফতার হলেন। এর উপরে চাপ বাড়াতে এ দিন কার্শিয়াঙে গিয়ে লেপচাদের সঙ্গে কথা বলেছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব।
এই পরিস্থিতিতে তাঁরা যে কিছুটা হলেও পিছু হটেছেন, তা জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির নেতৃত্বের কথাতেই স্পষ্ট। এ দিন বৈঠকের পরে কমিটির চেয়ারম্যান এনোস দাস প্রধান বলেছেন, “আমরা সব দিক মাথায় রেখেই আন্দোলনের রূপরেখা বদলেছি। পাহাড়ের মানুষ ৫ দিন ঘরে বসে থাকতে চাইছেন না। তাঁরা রাস্তায় নেমে গোর্খাল্যান্ডের দাবি জানাতে ইচ্ছুক। সে জন্য এক দিন ‘ঘরে বসে থাকবে জনতা’ কর্মসূচি পালন হবে। বাকি চার দিন জনতা রাস্তায় নামবে। কিন্তু, কোনও অবরোধ-ঘেরাও হবে না। আন্দোলনকারীরা যাতে বাইরের কোনও উস্কানি বা প্ররোচনায় পা না দেন, সেই ব্যাপারেও সকলকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।”
পাঁচ দিন ধরে লাগাতার ঘরে বসে থাকার ফতোয়া দিয়েও শেষ পর্যন্ত মোর্চা নেতৃত্ব যে পিছু হটেছেন, তাতে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখছেন পাহাড়বাসী। মোর্চার বিরোধী দল জএনএলএফের একাধিক নেতার উপলব্ধি, “আমরা পাহাড়ে বনধ ডাকার রেকর্ড করে ফেলেছিলাম। শেষ পর্যন্ত হলটা কি? জনতা তো আমাদের ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। ইতিহাসটা ভুললে গুরুঙ্গ মুশকিলে পড়বেন।”
ঘটনা হল, পাহাড়ের আনাচে-কানাচে কোথায় কী হচ্ছে, মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ, সে খবর রোজই মোর্চার কাছে পৌঁছচ্ছে। পাশাপাশি, পাহাড়ের সামগ্রিক পরিস্থিতি সামলাতে রাজ্য আরও কতটা কঠোর পদক্ষেপ করবে, তা-ও মোর্চা নেতারা ঠিক আঁচ করতে পারছেন না। বনধ কিংবা ভিন্ন নামে জনজীবন অচল করলে হাইকোর্ট আরও কঠোর নির্দেশ দিতে পারে। তা-ও মাথায় রাখতে হচ্ছে মোর্চা নেতৃত্বকে। তা ছাড়া, মোর্চার একপক্ষের মতে, জিএনএলএফের আন্দোলনের সময়ে পাহাড়ে যা পরিস্থিতি ছিল, এখন তেমন নেই। ফলে, বনধে আগের মতো সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া মেলার সম্ভাবনা কম।
সমতলে আর্থিক অবরোধ তৈরি করা নিয়েও মোর্চার মধ্যে দ্বিধা রয়েছে। এখন চা শিল্পকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। যদিও পাহাড় থেকে চা এবং কাঠ সমতলে যাওয়া রুখতে অর্থনৈতিক অবরোধের ডাক দেওয়ার প্রস্তাব দেন কয়েক জন মোর্চা নেতা। কিন্তু, বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের অধিকাংশের মত, তড়িঘড়ি এমন কিছু না করাই ভাল। কারণ, পাহাড়ের চা বাগানে সব মিলিয়ে ৭০ হাজার শ্রমিক রয়েছেন। পরোক্ষে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ ওই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এতে রাতারাতি চা শিল্পে সংশ্লিষ্টদের মোর্চা বিরোধী হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে।
কিন্তু মোর্চার অন্য পক্ষের মত, তেলঙ্গানার প্রেক্ষাপটে আন্দোলন জারি না-রাখলে পাহাড়ে জিএনএলএফের মতো দলগুলি ফের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে আসরে নামতে পারে। তা ছাড়া, রাজ্য-কেন্দ্র যাতে আলোচনায় ডাক দেয়, সেই লক্ষ্যে চাপ বজায় রাখতে এক দিনের জন্য হলেও পাহাড়ের মানুষকে ঘরবন্দি রাখার আন্দোলন জারি রাখতে হবে। এর পরেই আন্দোলনের সময়সীমা কমিয়ে এক দিন করার সিদ্ধান্ত হয়। বাকি চার দিনের আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়, ‘রাস্তায় থাকবে জনতা’। নেপালি ভাষায় ‘ঘর বাইরো জনতা’। সেই সঙ্গে মোর্চার পক্ষ থেকে এটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোনও ফতোয়া নয়, তাঁরা আশা করছেন, ওই সময়ে পাহাড়ের মানুষ দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, অফিসে না-গিয়ে রাস্তায় নেমে শান্তিপূর্ণ ভাবে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন করবেন। বাকি চার দিন সরকারি তরফে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার খোলা রাখা হলেও যেন কেউ না যান সে জন্য অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত হয়।
এই প্রসঙ্গে অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, “চা ও কাঠ সমতলে যাওয়া রোখার প্রস্তাব উঠেছে। আমরা এখনই অর্থনৈতিক অবরোধের রাস্তায় হাঁটতে চাই না। আগামী ৩০ অগস্ট ফের বৈঠক হবে। সেখানে পরের কর্মসূচি ঠিক হবে।”
আন্দোলনের কৌশল বদলানো প্রসঙ্গে মোর্চার এক কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা জানান, এতে হাইকোর্টের রোষের মুখেও পড়তে হবে না। অন্য দিকে, পাহাড়ের মানুষ রাস্তায় বার হতে পারলে তাঁদেরও ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। পাশাপাশি, আলোচনার ডাক পাওয়ার রাস্তাও এতে খুলতে পারে বলে মোর্চার ওই শীর্ষ নেতা মনে করেন।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.