গত লোকসভা ভোটের পর থেকে যে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল, পরের লোকসভা নির্বাচনের সামনে এসে শেষ পর্যন্ত তাতে গতিসঞ্চার হল! পশ্চিমবঙ্গে সংগঠনের পুনর্গঠন দরকার বলে এ বার আনুষ্ঠানিক ভাবে মেনে নিল সিপিএমের কেন্দ্রীয়
কমিটি। মানুষের সঙ্গে হারানো সংযোগ ফিরে পেতেই সংগঠন নতুন করে সাজা উচিত বলে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছেন।
রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে বিপর্যয়ের প্রাথমিক কাঁটাছেড়া করতে বসেই সংগঠনে রদবদলের প্রয়োজনীয়তা টের পেয়েছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। পঞ্চায়েতের ফলপ্রকাশের পরে শনি-রবিবারই প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ছিল। বৈঠকে শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে যে রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে, সেখানেই পশ্চিমবঙ্গ সংক্রান্ত অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে সাংগঠনিক ঘাটতির কথা।
রিপোর্টের ১৬ পাতায় পরিষ্কারই বলা হয়েছে: ‘খেটে-খাওয়া মানুষের দাবিদাওয়া মাথায় রেখে সংগ্রামের গতি বাড়াতে হবে। মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলার লক্ষ্যেই দলের সংগঠনকে নতুন
করে সাজাতে হবে।’ এই কাজে গাফিলতি আর মেনে নেওয়া যাবে না বলেও রিপোর্টে এ বার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। দু’বছর আগে বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির পরে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করেছিল কেন্দ্রীয় কমিটি। কিন্তু এ ভাবে সংগঠন ঢেলে সাজার কথা বলা হয়নি।
এ বার যা হয়েছে এবং যাকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই চিহ্নিত করা হচ্ছে সিপিএম সূত্রে।
এ বারের পঞ্চায়েত ভোটের ফলকে জনমতের সঠিক প্রতিফলন বলে অবশ্য মনে করছে না সিপিএম। আলিমুদ্দিনের এই মতেই সিলমোহর দিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির রিপোর্ট। প্রাক-নির্বাচনী এবং ভোটের সময় সন্ত্রাস, তার পরে গণনায় কারচুপির জন্যই মানুষের মনোভাব পঞ্চায়েত ভোটের ফলে পুরোপুরি ধরা পড়েনি বলে এ কে জি ভবনেরও অভিযোগ।
বাংলায় গণতন্ত্রের উপরে আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশে সারা দেশের গণতান্ত্রিক শক্তির সহমর্মিতা জোগাড় করতে সর্বভারতীয় স্তরে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট সক্রিয় থাকবে বলেই রিপোর্টে জানানো হয়েছে। কিন্তু একই অধ্যায়ে যে ভাবে মানুষের সঙ্গে সংযোগ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা (তাতে সময় লাগবে বলেও মেনে নেওয়া হয়েছে) এবং সাংগঠনিক স্তরে পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হয়েছে, তাতেই স্পষ্ট যে, সন্ত্রাসের বাইরে নিজেদের দুর্বলতার দিকটাও আর অস্বীকার করতে পারছেন না প্রকাশ কারাটেরা। কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “কিছু কাজ অপ্রিয় হলেও জরুরি!”
কেন্দ্রীয় কমিটি দলের অন্দরে এই মত স্পষ্ট করে দেওয়ায় আলিমুদ্দিনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেবদের অবশ্য সুবিধাই হল। স্থানীয় স্তরে মানুষের অপছন্দের মুখকে আর সামনে রাখা যাবে না বলে পঞ্চায়েত ভোটের পরে দলের মধ্যে নতুন করে সরব হয়েছেন বুদ্ধবাবু। বস্তুত, এ বারের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের আগে দিল্লি থেকে নির্দিষ্ট করে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মত জেনে নিয়েছেন পলিটব্যুরোর একাধিক সদস্য। জেলা স্তরে সংগঠনে কিছু রদবদলের দাবি দলের মধ্যেই
উঠেছে, রাজ্য নেতৃত্বও তা বিবেচনায় রেখেছেন। পঞ্চায়েতের ফলপ্রকাশের পরে এই সপ্তাহেই ২২ অগস্ট রাজ্য কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা। এক দিনের বৈঠকেই রাতারাতি যাবতীয় রদবদলের সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে না ঠিকই। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির মত সামনে রেখে পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে বুদ্ধবাবুদের সুবিধা হবে।
সিপিএমের মধ্যেই এখন চর্চা চলছে, অতীতে ক্ষমতায় থাকার সময় যে সব জায়গায় দলের নেতাদের বিরুদ্ধে আধিপত্য চালানো বা ঔদ্ধত্য-অস্বচ্ছতার অভিযোগ ছিল, সেখানে পঞ্চায়েতের ফল বেশি খারাপ হয়েছে। এই প্রেক্ষিতেই দুই মেদিনীপুর, বর্ধমানের মতো জেলায় নেতৃত্বে রদবদলের দাবি প্রবল। পূর্ব মেদিনীপুরে লক্ষ্মণ শেঠের ঘনিষ্ঠ জেলা সম্পাদক কানু সাহু এবং পশ্চিমে সুশান্ত ঘোষের ‘গুরু’ দীপক সরকারকে এ বার অব্যাহতি দিয়ে নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে। বর্ধমান জেলাকে প্রয়োজনে সাংগঠনিক ভাবে দু’ভাগে ভেঙে পরিস্থিতি সামলানোর কথা হচ্ছে। গত পার্টি কংগ্রেসে সব কমিটির সম্পাদকের পদে থাকার মেয়াদ তিন বারে বেঁধে দেওয়ায় কিছু নেতাকে আগামী দিনে এমনিতেই সরতে হবে।
তবু জেলায় প্রভাব বিস্তার করে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন নিয়ে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র দোহাই দিয়ে কিছু নেতা যাতে পদে থেকে যেতে না পারেন, তার জন্য সম্মেলন-পর্বের আগেই রদবদল সেরে নেওয়ার পক্ষপাতী রাজ্য নেতৃত্বের বড় অংশ।
শত অভিযোগ মাথায় নিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরে লক্ষ্মণবাবু, পশ্চিমে দীপকবাবু বা উত্তর ২৪ পরগনার শাসনে মজিদ মাস্টারের মতো নেতারাই দিনের পর দিন সংগঠনকে টিকিয়ে রেখেছেন, বড় করেছেন।
কিন্তু দলীয় নেতৃত্বের একাংশের যুক্তি, পশ্চিমবঙ্গে ভোটের যা প্রবণতা, আগামী লোকসভা ভোটে দলের ভাগ্যে বিরাট কিছু জোটার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই প্রয়োজনমাফিক পরিবর্তন সেরে নিয়ে ভোটে গেলে তার চেয়ে খুব খারাপ কিছু হবে না। |