জন্মেই অনাদর, হাসপাতালে মেয়েদের আনছে না পরিবার
রুগ্ণ মেয়ে পড়ে থাকছে ঘরে। সদ্যোজাত সন্তানটি পুত্র হলে তবেই তাকে বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে ছুটছেন পরিবারের লোকেরা। জেলায় জেলায় ‘সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিইউ) চালু করার পরে এই ছবি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর তাতেই কপালে ভাঁজ পড়েছে স্বাস্থ্যকর্তাদের। কন্যাশিশুদের জন্য নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধে সত্ত্বেও পরিবারগুলিতে মেয়েদের অনাদর যে কমেনি, আবারও তার প্রমাণ মিলছে বলেই মনে করছেন তাঁরা।
দশ বছর অন্তর জনগণনা হয় ভারতে। তার রিপোর্টেই স্পষ্ট, পুরুষদের অনুপাতে মেয়েদের সংখ্যা অনেকটাই কম। এ রাজ্যে প্রতি হাজারে মহিলা ৯৫০। দেখা যাচ্ছে, ছয় বছরের নীচে শিশুদের মধ্যেও প্রতি হাজার শিশুপুত্রে রয়েছে ৯৪৭ শিশুকন্যা। জনসংখ্যার নিরিখে হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে ২ লক্ষ ৬১ হাজার কন্যাশিশু ‘উধাও’ (‘মিসিং’)। তারা হয় জন্মাচ্ছে না, না হলে জন্মের পর অসুখে-অবহেলায় মারা যাচ্ছে।
কেন কমছে কন্যাশিশুদের সংখ্যা? এত দিন কন্যাভ্রূণ হত্যার দিকে বিশেষ করে নজর দিয়েছে সরকার ও সমাজ। আইন করে গর্ভের ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ণয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ক্লিনিকগুলির উপরে নজরদারিও করা হচ্ছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলেও কন্যাশিশুর অনুপাত কমতে থাকায় বিশেষজ্ঞরা অনেকেই মনে করছিলেন, ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ণয়ের ব্যয়সাপেক্ষ প্রযুক্তিই প্রধান কারণ না-ও হতে পারে। জন্মের পরে পরিবারের অবহেলায় মেয়েদের অসুস্থতা ও মৃত্যুও একটি বড় কারণ।
পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালগুলিতে এখন তারই সাক্ষ্য মিলছে। দেখা যাচ্ছে, যে কন্যা শিশুটিকে সময়মতো চিকিৎসা করে বাঁচানো যেতে পারত, হাসপাতালে নিয়ে আসায় পরিবারের অনিচ্ছার জন্য তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হচ্ছে। এর ফলে এক দিকে যেমন জনসংখ্যায় পুরুষ-নারীর ফারাক কমছে না, অন্য দিকে তেমনই নবজাতকের মৃত্যুহার কমানোর সরকারি প্রচেষ্টা বিফল হচ্ছে।
কেন এমন হচ্ছে? কথা হচ্ছিল পুরুলিয়ার কেশরগড়িয়ার ডমরু মাহাতোর সঙ্গে। রুখুসুখু চেহারার ডমরু অন্যের বাড়ি গৃহকাজ করেন। তার মেয়ে জন্মেছিল পুরুলিয়ার দেবেন মাহাতো হাসপাতালে। সেখানকার নবজাতক ইউনিট এ রাজ্যে নবজাতক চিকিৎসার মডেল। মাত্র ৯৫০ গ্রাম ওজন হয়েছিল ডমরুর মেয়ের। শিশুকন্যাটির ওই ইউনিটে ঠাঁই পাওয়ার কথা। কিন্তু ডমরু বা তাঁর স্বামী বিশন কেউই মেয়েকে নিয়ে আসেননি হাসপাতালে। চিকিৎসার তো খরচ নেই। তা হলে না আনার কারণ কী? ডমরু-বিশন বললেন, ডাক্তাররা বলেছিলেন ৯৫০ গ্রামের শিশুটিকে বিপন্মুক্ত করার ওজনে পৌঁছতে সময় লাগবে মাস খানেক। ওই সময়টা কাজ ফেলে রোজগার নষ্ট করে সদরে থাকতে রাজি নন তাঁরা কেউই। “বেটাছেলে হলে তবু কথা ছিল। বিটির জন্য নয়।” সাফ বললেন বিশন। তাঁদের কন্যাটি জন্মের চার দিনের মাথায় মারা যায়।
একই ছবি ঝাড়গ্রামের বিজলি হাঁসদার ঘরে। বিজলির দুটি ছেলে। তৃতীয় সন্তানটি জন্মায় সময়ের অনেক আগেই। প্রত্যাশিত ভাবেই ওজন কম। এবং কন্যা। অবধারিত ভাবেই ওজন অনেক কম। ঝাড়গ্রামে নতুন নবজাতক ইউনিট খুলেছে সরকার। কিন্তু সেখানে বিজলি তাঁর সন্তানকে নিয়ে যাননি। কেন? “মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকলে ঘরের ছেলেদুটোর যত্ন হত না!”
জন্মের পরে শিশুকন্যাদের পরিচর্যার অভাব, চিকিৎসার অভাব যে কন্যাসন্তানদের ‘উধাও’ হওয়ার অন্যতম কারণ, তা অমর্ত্য সেনও বলেছেন। তাঁর বইয়ে (‘ইকোনমিক ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল অপারচুনিটি’) তিনি দেখিয়েছেন, ১৯৮১-র জনগণনা রিপোর্টে এক বছর-বয়সী পুত্র-কন্যাদের মধ্যে মৃত্যুহারেরখুব বেশি তফাত নেই (হাজারে ১১৩ পুত্র, ১১৫ কন্যা মারা যাচ্ছে)। কিন্তু পাঁচ বছরের শেষে কন্যাদের মৃত্যুহার পুত্রদের চাইতে অনেকটাই বেশি (প্রতি হাজারে পুত্র ৬৮, কন্যা ৯১ মারা যাচ্ছে)। বড় হওয়ার প্রতি পদক্ষেপে পারিবারিক অনাদর বহু শিশুকন্যাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এর সূচনাটাই হয়তো স্পষ্ট হচ্ছে এ রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলির নবজাতক ইউনিটগুলি থেকে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নাগালের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও একাধিক ক্ষেত্রে তার সদ্ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে না পরিবার।
পুরুলিয়া নবজাতক ইউনিটে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০৭টি শিশু ভর্তি হয়েছে। তার মধ্যে শিশু কন্যার সংখ্যা মাত্র ৫৬টি। অথচ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগের হিসেব বলছে, পুত্র ও কন্যা সন্তানের জন্মের হার প্রায় একই। সদ্যোজাত শিশুদের মধ্যে রুগ্ণ মেয়ের সংখ্যাও ছেলেদের তুলনায় কম নয়। কিন্তু ছবিটা বদলে যায় তার পরবর্তী ধাপগুলিতেই। রুগ্ণ, কম-ওজনের সন্তানকে হাসপাতালের বিশেষ ইউনিটে টানা মাসখানেক বা তারও বেশি রেখে স্থিতিশীল করার জন্য যে ধৈর্য্য, অর্থ এবং সময় প্রয়োজন, মেয়েদের জন্য তা দিতে রাজি নয় বহু পরিবার। অনেকেই বলছেন, কন্যা সন্তানকে বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে পড়ে থেকে নিজেদের কাজের দিন নষ্ট করতে চান না।
ঝাড়গ্রাম নবজাতক ইউনিটে মে মাসে শিশু পুত্র ভর্তি হয়েছে ২৩, শিশু কন্যা ৮। এপ্রিলে পুত্র ২০, কন্যা ৯। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ, মালদহ মেডিক্যাল কলেজেও খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, পরপর কয়েক মাসের পরিসংখ্যান অনুসারে, কন্যাশিশুদের সংখ্যা শিশুপুত্রদের চাইতে ধারাবাহিক ভাবে বেশ খানিকটা কম। এমনকী, কলকাতাও এর ব্যতিক্রম নয়।
কন্যাশিশুদের প্রতি এই বৈষম্যের মনোভাব চিকিৎসকরা রোজই প্রত্যক্ষ করছেন। কলকাতার বি সি রায় শিশু হাসপাতালের অধ্যক্ষা মালা ভট্টাচার্যের কথায়, “যমজ সন্তান হল। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। দুজনেরই ওজন কম। বাবা-মা আকুল হয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘যেমন করে হোক ছেলেটাকে বাঁচিয়ে দিন।’ আসলে চিকিৎসা নিখরচায় হলেও, হাসপাতালে আসার গাড়ি, বাড়ির লোকের থাকা-খাওয়ার জন্য যে খরচ হয়, অনেকে সেটাও বহন করতে পারেন না।” হাসপাতালে থাকা মানে দিনমজুর পরিবারে কাজের দিন নষ্ট, রোজগার নষ্ট। ছেলের জন্য সেই ‘ক্ষতি’ সইতে রাজি থাকলেও, মেয়ের জন্য তা বইতে চান না অনেকে।
নবজাতক বিশেষজ্ঞ এবং নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক অসীম মল্লিক বলেন, “দরিদ্র পরিবারগুলিতে শিশুকন্যাদের জন্য টাকা খরচে অনিচ্ছা আগাগোড়াই ছিল। হাসপাতালে মেয়েদের আনাই হত কম। এখন নবজাতক ইউনিটে সব পরিসংখ্যান রাখা হচ্ছে বলে বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে।”
রাজ্যে মা ও শিশুর মৃত্যুহার কমাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে টাস্ক ফোর্স গড়েছেন, তার সদস্যরাও এ কথা মেনে নিয়েছেন। টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিষয়টা খুবই আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বিভিন্ন এসএনসিইউ-এর শিশু ভর্তির পরিসংখ্যান থেকে এ কথা স্পষ্ট যে সেখানে পুত্রসন্তানের চিকিৎসা করাতেই মা-বাবা বেশি আগ্রহী। কন্যাসন্তান রুগ্ণ হলে তাকে বহু ক্ষেত্রেই বাড়িতে রেখে দেওয়া হচ্ছে। এর মোকাবিলায় লাগাতার প্রচার প্রয়োজন। কী ভাবে সরকারি তরফে আমরা তা করব, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.