মনের জোরে বয়সকে হার মানিয়ে ‘মাঠের রানি’ ইলা
ক সময় খেলাচ্ছলে ছেলের সঙ্গে মাঠে দৌড়তেন। তিনিই এখন দেশ-বিদেশের মাঠে দাপিয়ে বেড়ান। জিতে নেন একের পর এক স্বর্ণ-রৌপ্যপদক।
ঘর সংসারের দায়িত্ব বা ৫৩ বছর বয়স, কোনও কিছু বাধা নয় ঝাড়গ্রামের ইলা সিংহের কাছে। মনের জোর সম্বল করে বয়স্কদের জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে সোনা জয়ের নজির গড়েছেন ইলাদেবী। বয়স্কদের জাতীয় ক্রীড়ায় ১১ বার যোগ দিয়ে ইলাদেবীর ঝুলিতে রয়েছে ২২টি সোনা, ১০টি রুপো ও ৩টি ব্রোঞ্চ পদক। ৫ হাজার ও ১০ হাজার মিটার দৌড়, ৫ কিলোমিটার হাঁটার মতো নানা রকম ইভেন্টে তিনি সাবলীল। ২০০৬ সালে বেঙ্গালুরুতে বয়স্কদের এশিয়াডে ৫ কিমি হাঁটায় সোনা জেতেন ইলাদেবী। ২০০৮ সালে তাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বয়স্কদের এশিয়াডে একশো মিটার রিলে দৌড়ে জেতেন রুপো, চারশো মিটার রিলেতে পান ব্রোঞ্জ। ২০১০ সালে মালয়েশিয়াতেও রুপো জেতেন ইলাদেবী। সাফল্যের ধারা এখনও অব্যাহত। চলতি মাসের গোড়ায় শ্রীলঙ্কায় বয়স্কদের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাতেও ৫ কিমি হাঁটায় রুপো এবং দু’কিমি ‘স্টেপল চেজ’-এ ব্রোঞ্জ জিতে ফিরেছেন ঝাড়গ্রামের বাছুরডোবা এলাকার এই প্রৌঢ়া। ঝাড়গ্রামের মহকুমাশাসক তথা ঝাড়গ্রাম সাব ডিভিশনাল মাস্টার্স অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাসব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ইলাদেবী প্রমাণ করেছেন, “ইচ্ছে ও মনের জোর থাকলে যে কোনও বাধা সরিয়ে সফল হওয়া যায়। উনি জঙ্গলমহলের গর্ব।”

জয়ের স্মারক হাতে ইলা সিংহ। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
সময়টা নব্বইয়ের দশক। ছেলেকে নিয়ে প্রায় রোজই মাঠে যেতেন ইলাদেবী। ছেলের সঙ্গে ছুটোছুটি করতেন। সেই সময়ই এক দিন প্রবীণ ত্রীড়াবিদ হরেন্দ্রনাথ দাসের নজর পড়ে তাঁর উপর। হরেন্দ্রনাথবাবু তখন ‘ঝাড়গ্রাম ভেটেরান্স স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন’ -এর সম্পাদক। তাঁর উদ্যোগেই ১৯৯৮ সাল থেকে মহকুমা, জেলা ও রাজ্য স্তরে বয়স্কদের একাধিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সফল হন ইলাদেবী। ২০০২ সালে বেঙ্গালুরুতে জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতাতেও সোনা জেতেন। ছাপোষা ঘরের বউ। তাই অর্থাভাবের সঙ্কটও ছিল। ২০০৪ সালে প্রথম বিদেশযাত্রার সময়ই কিছুটা সমস্যা হয়। সে বার ব্যাংকক এশিয়াডে যাওয়ার জন্য চাঁদা তুলে কিছু টাকা সংগ্রহ করেন ইলাদেবী। বাকিটা ধার। টাকার অভাবে ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়া এবং শ্রীলঙ্কায় আন্তর্জাতিক মিটে যেতে পারেননি। ২০০৭ সালে ইতালির রিচিওন শহরে বয়স্কদের ওর্য়াল্ড মিটে যাওয়ার সুযোগ হয়। সে বার ভাষার সমস্যায় নির্দিষ্ট সময়ে ইভেন্টে যোগ দিতে পারেননি। সেই খেদ আজও রয়েছে। ২০১১ সালে আমেরিকার সেক্রেমেন্টোয় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড মিট-এ দু’কিমি স্টেপল্‌ চেজ-এ অংশ নিয়ে কোনও পদক জয় করতে না পারলেও ‘অল অফ দ্য বেস্ট’-এর শংসাপত্র পান। বয়স্কদের অলিম্পিকে সোনা জয়ের খিদেটা তাই রয়ে গিয়েছে।
ইলা দেবীর কোচ নেই। নেই স্পনসর। তাঁর কথায়, “আমি নিজেই নিজের কোচ।” অনুশীলনের কোনও বাঁধাধরা সময় নেই। সময় পেলেই কাছাকাছি মাঠে গিয়ে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ ও জগিং সেরে নেন। সরকারি সাহায্যও সে ভাবে জোটেনি। শুধু ২০১২ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে ‘বিবেক পুরস্কার’ বাবদ ৫ হাজার টাকা পেয়েছেন ইলাদেবী। প্রতিবারই ধারদেনা করে প্রতিযোগিতায় যোগ দেন। তবে কখনও স্বামী-সন্তানদের কাছে হাত পাতেননি। নিজে বেসরকারি স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে এজেন্টের কাজ করেন। তা থেকে মাসে তিন-চার হাজার টাকা রোজগার হয়। বিদেশে গেলে কিছু অর্থ সাহায্য নেন। বাদবাকি লক্ষাধিক টাকা ধার করতে হয়। পরে তা শোধ করেন।
ছোট থেকেই অ্যাথলিট হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন ইলাদেবী। পড়াশোনাও করেছেন নিয়ম মেনে। প্রথমে বিজ্ঞানে স্নাতক, পরে বিএড। স্বামী অনিল সিংহ রাধানগর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। নিজের স্বপ্ন সফল করার জন্য ইলাদেবী কিন্তু সংসারে অবহেলা করেননি। তিন ছেলেমেয়েকে যথাযোগ্য মানুষ করেছেন। বড় মেয়ে অনিমা বেলপাহাড়ি গ্রামীণ হাসপাতালের চিকিত্‌সক। মেজ মেয়ে মনিমা এমবিবিএস পাস করে এখন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্নশিপ করছে। ছেলে সুখদেব ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন গত বছর। ইলাদেবীর কথায়, “সংসারের কর্তব্যে কোনওদিন অবহেলা করিনি। তবে আমার নিজস্ব একটা জগত্‌ রয়েছে। স্বামী-ছেলেমেয়েদের সমর্থন পেয়েছি বলেই অভাবের মধ্যেও লক্ষ্য জয় করেছি। এখন ইচ্ছে বয়স্কদের অলিম্পিক-এ সোনা পেতে হবে। মায়ের স্বপ্নপূরণে পাশে রয়েছে তিন সন্তানও। অণিমা, মণিমা ও সুখদেব বলছেন, “অনেক কষ্ট করে মা বড় করেছেন। ওই স্বপ্ন সফল করতে যথাসাধ্য করব।”




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.