কলিকাতাও পিছাইয়া নাই। ভিন্ রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিংয়ের খবর শুনিয়া সম্ভবত এই রাজ্যের পড়ুয়াদের মনে আফসোস হইত হায়! বাঙালির কি তবে সেই কবজির জোর নাই, যাহাতে নবীন ছাত্রদের নতজানু করিয়া রাখা সম্ভব হয়? তারাতলার মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা সেই আফসোস মিটাইয়া দিয়াছে। ভিন্ রাজ্যের দুই পড়ুয়া নবীনবরণের প্রাবল্য সহ্য না করিতে পারিয়া বিদায় লইল। দ্বিতীয় হইতে চতুর্থ বর্ষের ছাত্রদের বিরুদ্ধে তাহাদের অভিযোগগুলি পরিচিত। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়াও। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের র্যাগিং প্রতিরোধ শাখার ফোন পাইবার পর কর্তৃপক্ষ নড়িয়া বসিয়াছিল। সামান্যই। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ম আছে, র্যাগিংয়ের অভিযোগ পাইলে থানায় লিখিত ভাবে অভিযোগ দায়ের করা প্রতিষ্ঠান-কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। তারাতলার প্রতিষ্ঠানটির নির্দেশক তাহা করেন নাই, কারণ তিনি প্রয়োজন বোধ করেন নাই। সরকারি নির্দেশে যে আদৌ তাঁহার বিবেচনার কোনও স্থান নাই, এই কথাটি তিনি সম্ভবত বুঝিয়াও বুঝেন নাই। তিনি অভিযুক্ত ছাত্রদের আড়াল করিতে এমনই ব্যস্ত যে যুক্তি খাড়া করিয়াছেন, অভিযোগকারী দুই জনের দেহে আঘাতের কোনও চিহ্ন যেহেতু নাই, অতএব এই ঘটনাটিকে ‘র্যাগিং’ বলিতে তিনি নারাজ। এমন নির্দেশক মহোদয় আছেন বলিয়াই অভিযুক্ত ছাত্রগুলিও আছে। ছাত্ররা যাহা করিয়াছে, তাহা নিতান্ত অধিকারজ্ঞানেই করিয়াছে নবীনদের সহিত অসভ্যতার ট্র্যাডিশনসঞ্জাত অধিকার। নির্দেশক যাহা করিতেছেন, তাহাও উচিত মানিয়াই করিতেছেন নবীনের প্রাণসংশয় না হওয়া পর্যন্ত অসভ্যতার প্রথা বজায় রাখিবার ঔচিত্য।
অতএব, অপরাধী খুঁজিতে বসিয়া কেবলমাত্র ছাত্রদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিলে তাহা খণ্ডবিচার হইবে। তাহারা প্রত্যক্ষ অপরাধী। কিন্তু প্রশ্রয়ের যে ফল্গুধারাটি তাহাদের অপরাধের শিকড়ে জলসিঞ্চন করিয়াছে, তাহাকেও শনাক্ত করা কর্তব্য। প্রতিটি সামাজিক ব্যাধিই এই ভাবে টিকিয়া থাকে এক দল প্রত্যক্ষ ভাবে অপরাধ করে, অন্য দল সেই অপরাধ হইতে চোখ ফিরাইয়া থাকে। র্যাগিং-এর ক্ষেত্রেও বারংবার তাহাই হয়। বস্তুত, এই ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের দায় আরও বেশি। যে নূতন ছাত্রটি বাড়ি ছাড়িয়া প্রতিষ্ঠানের দরজায় আসিয়া দাঁড়ায়, তাহার একমাত্র আশ্রয়স্থল প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ছাত্ররা প্রথম বার বাড়ি ছাড়িয়া অন্যত্র থাকিতে আসে, সেখানে মা-বাবার নিরাপত্তা নাই, পরিচিত পরিবেশের আশ্বাস নাই। তাহারা সদ্য স্কুলের চৌকাঠ ডিঙাইয়া আসে বৃহত্তর, দুর্ধর্ষ পৃথিবীর সহিত ইহাই তাহাদের প্রথম পরিচয়। এই অবস্থায় তাহাদের অধিকতর নিরাপত্তা প্রয়োজন, নিরবচ্ছিন্ন মমতা প্রয়োজন। তাহা জোগাইবার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের উপরই বর্তায়। সেই দায়িত্ব অস্বীকার করিবার কোনও পথ নাই। উচ্চতর শ্রেণির পড়ুয়ারা যাহাতে নবীনদের সহিত সহযোগিতা করে, অগ্রজপ্রতিম আচরণ করে, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে বইকী। পুরাতন পড়ুয়াদের বারংবার বুঝাইতে হইবে। তাহারা উচ্চতর শ্রেণিতে পড়িতে পারে, কিন্তু খুব বড় তো নহে। তাহাদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ জাগাইতে হইবে। সকলে বুঝিবে না, সত্য। সেই অবুঝদের প্রতি কঠোর হইতে হইবে। র্যাগিংয়ের ঘটনার ছিঁটাফোঁটাও সহ্য করা চলিবে না ‘জিরো টলারেন্স’-ই একমাত্র নীতি। সেই কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হইলে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষেরও শাস্তি হওয়া বিধেয়। র্যাগিং ঠেকাইবার আর কোনও সহজ রাস্তা নাই। |