মিশরে সামরিক স্বৈরাচারের দাঁতনখ ফুটিয়া বাহির হইয়াছে। দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম এক জন নির্বাচিত এবং অসামরিক প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুর্সিকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া সেনাবাহিনী যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কাষ্ঠপুত্তলদের বিভিন্ন মন্ত্রিত্বে অভিষিক্ত করিয়াছিল, তাহাদের নামও আজ সহসা কেহ মনে করিতে পারে না। কারণ এখন কায়রো-সহ মিশরের বিভিন্ন শহর ও জনপদে কেবল জেনারেলদের ভারী বুটের পদধ্বনি, ট্যাংক ও সাঁজোয়া গাড়ির কামান-গর্জন, নিরস্ত্র প্রতিবাদী মানুষদের উপর গণহত্যার উদ্যত সঙিন। এই প্রতিবাদীরা দেশময় রাস্তায় নামিয়া নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের অগণতান্ত্রিক উৎখাতের বিরোধিতা করিতেছেন। তাঁহারা মুর্সি-সমর্থক, এমনকী মুসলিম ব্রাদারহুড-এর সদস্যও হইতে পারেন। হইতে পারেন ব্রাদারহুডের তৈয়ার করা জাস্টিস অ্যান্ড ফ্রিডম পার্টির সদস্যও। গণতন্ত্রে সে অধিকার তাঁহাদের থাকার কথা। কিন্তু মিশর আজ আর গণতন্ত্র নয়, তাহা ফৌজি জেনারেলদের স্বৈরশাসনে ফিরিয়া গিয়াছে।
সেনাবাহিনী কোনও বিরোধিতা, মতান্তর, প্রতিবাদ সহ্য করিতে প্রস্তুত নয়। প্রতিবাদীদের তাই নির্বিচারে হত্যা করা হইতেছে। কেবল কায়রো নয়, আলেকজান্দ্রিয়া, পোর্ট সইদ-সহ সব শহরেই এই সেনা-তাণ্ডব চলিতেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ ও তাহার নিরাপত্তা পরিষদ চুপচাপ সব দেখিতেছে। যেমন দেখিতেছে মিশরীয় সেনাবাহিনীকে সর্বাধিক সামরিক ও আর্থিক অনুদান দেওয়া মার্কিন প্রশাসন। ‘আরব বসন্ত’ রক্তের হোলিতে রাঙিয়া গিয়াছে। মিশরের এই সংঘর্ষকে গণতন্ত্র বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার সংঘাত বলিয়া চালাইবার একটি প্রয়াস লক্ষণীয়। সেই সংঘাতে পশ্চিমী গণতন্ত্র ও তাহার ধামাধরা গণমাধ্যম ধর্মনিরপেক্ষতাকে গণতন্ত্রের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে উৎসুক। তাই মিশরের প্রথম অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে মহম্মদ মুর্সি পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতাসীন হইলেও এক বছর যাইতে না যাইতে তাঁহাকে অপসারণের দাবিতে তাহরির স্কোয়ারে ‘মুর্সি-বিরোধীরা’ জমায়েত হন। তাঁহাদের মধ্যে অন্যান্যদের সহিত হোসনি মুবারকের অনুগামীরাও বহুল সংখ্যায় হাজির ছিলেন। সেনাবাহিনী, বিচারবিভাগ এবং আমলাতন্ত্রেও মুবারক জমানার লোকেরাই জাঁকিয়া বসিয়াছিল। তাহাদের মিলিত প্রয়াসই তাহরির স্কোয়ারের তথাকথিত ‘গণ-আন্দোলন’-এর সহিত মিলিয়া মুর্সির প্রস্থানের পথ প্রশস্ত করে। মিশর হইতে ব্রাদারহুডকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা সম্পূর্ণ।
কিন্তু গণতন্ত্রের যে প্রতিনিধিত্বমূলক বৈধতা থাকে, সামরিক স্বৈরাচার কিংবা তাহার কাঁধে ভর দিয়া ক্ষমতায় বসা রাজনীতিকদের তাহা থাকে না। তাই জেনারেলদের খাড়া-করা পুতুল সরকারকে মিশরবাসী কখনও নিজেদের সরকার ভাবিবেন না। গণতন্ত্রের জন্য তাঁহাদের আকাঙ্ক্ষা ফল্গুধারার ন্যায় বহিতেই থাকিবে। জেনারেলদের তত্ত্বাবধানে নূতন করিয়া যে-নির্বাচনই মিশরে অনুষ্ঠিত হউক, বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন ব্রাদারহুড বা জাস্টিস অ্যান্ড ফ্রিডম পার্টিকে বাহিরে রাখিয়া সংঘটিত তেমন জনাদেশ বৈধতা পাইবে না। মিশরের জেনারেলদের এক দিন ব্রাদারহুডের জনপ্রিয়তা শিরোধার্য করিতে হইবে। মহম্মদ মুর্সি শাসনকার্যে কোনও ভুল করিয়া থাকিলে তাহা শুধরাইবার সময় ও সুযোগ তাঁহাকে দেওয়া যাইত। পাঁচ বৎসরের মেয়াদ তাঁহার ছিলই। জেনারেলদের যে আর তর সহিল না, তাহার কারণ, তাঁহারা সম্ভবত ভয় পাইতেছিলেন, এই পাঁচ বছরে বাহিনীকে হয়তো তাহাদের জন্য সকল গণতন্ত্রেই নির্দিষ্ট স্থান ছাউনিতে ফিরিয়া যাইতে হইবে। সেই সম্ভাবনা বানচাল করিতেই সামরিক অভ্যুত্থান, ব্রাদারহুড সমর্থকদের গণহত্যা, রক্তস্নান। তবু মিশরের প্রতিবাদী জনসাধারণের রাত্রির তপস্যা কালক্রমে সূর্যালোকিত দিনের আবাহন করিবেই। |