সম্পাদক সমীপেষু...
আজও ভুলিনি
মৃত্যুর এত বছর পরেও এক জন প্রকৃত জ্ঞানী, গুণী, ভদ্র, রসিক, ধার্মিক ব্যক্তির আলোচনা (‘কে সি নাগ’, সুস্নাত চৌধুরী, রবিবাসরীয়, ১৪-৭) দেখে অভিভূত হলাম। ঘটনাসূত্রে আমি ওঁর জ্ঞাতি সম্পর্কে নাতি, গুড়াপ নাগপাড়ায় ওঁর ঠিক পাশের বাড়িতেই থাকি। (বর্তমানে কর্মসূত্রে শ্রীরামপুরে থাকি।) ছাত্রজীবনে ওঁকে দেখেছি খুব কাছ থেকে। উনি যখন কলকাতা থেকে ‘অন্তরের টানে’ নিজের প্রিয় জন্মস্থানে সাদা গাড়িতে করে আসতেন, তখন আমাদের পাড়া ও গুড়াপের বাসিন্দাদের সে কী আনন্দ ও উৎসাহ লেগে থাকত। (গুড়াপে ওঁর বাড়িই প্রায় প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যান দ্বারা নির্মিত) নিয়ম করে উনি রোজ ভোরে উঠে ঠিক ছ’টার মধ্যে সাদা খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবি পরে শৌখিন সরু লাঠি নিয়ে মর্নিং ওয়াক সেরে বাড়ি ফিরতেন। সর্বদা ছড়িয়ে থাকত মুখে হাসি আর প্রবল ব্যক্তিত্ব। ঘড়ি ধরে ঠিক বারোটায় দুপুরের আহার সারতেন। কত দিন দেখেছি, বিকেলে কানের কাছে রেডিয়ো নিয়ে মোহনবাগানের খেলার রিলে শুনছেন। মোহনবাগান গোল করার পর হাত ছুড়ে সে কী উল্লাস ওঁর। কেবল দেখতাম বই পড়ছেন, বই হাতে বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এক দিন সাহস করে জ্যাঠামশাইকে (বড় ছেলে দেবীপ্রসাদ নাগ) বলে দাদুর কাছে খুব ভয়ে ভয়ে দেখা করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, থরে থরে বিছানায়, টেবিলে সাজানো বই। অভেদানন্দের শ্রীরামকৃষ্ণ প্রসঙ্গ, গাঁধীজির বই, বিবেকানন্দের ধর্ম প্রসঙ্গ প্রভৃতি...। গিয়ে প্রণাম করতেই সারল্য অথচ গাম্ভীর্য মাখানো হাসিতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কথা প্রসঙ্গে সেই বিখ্যাত তৈলাক্ত বাঁশ আর চৌবাচ্চার জলের প্রসঙ্গ উঠল। জ্বলজ্বল করছে সেই স্মৃতি। হাতের কাছে ছোট্ট একটা কাগজে অঙ্ক দুটো বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। যা আজও ভুলিনি। কত সহজে অঙ্ক করা যায় তা বুঝেছিলাম সে দিনই।
কেন মেয়ের পদবি নেই
কেন মেয়ের পদবি নেই, প্রশ্ন বারবার’ (২১-৭) শীর্ষক সংবাদ পড়ে অনন্যচেতা নামের খুদে মেয়েটির এবং তার বাবা-মায়ের করুণ অবস্থার জন্য যারপরনাই লজ্জিত হলাম। শুধুমাত্র ধর্ম ‘মনুষ্যত্ব’ ও নাম ‘পদবিহীন’ হওয়ার জন্য বাচ্চা মেয়েটি যদি শিক্ষাসনে অপাঙ্ক্তেয় হয়, তা হলে একজন শিক্ষিকা হিসাবে এই সমাজে শিক্ষাবিস্তারে ব্যর্থতার দায়ভাগ স্বীকার করছি। সংবাদ অনুযায়ী অনন্যচেতার ভর্তি হতে চাওয়া বিদ্যালয়গুলিতে তার পদবিহীনতা ও মনুষ্যত্ব-ধর্ম নিয়ে যে প্রশ্ন করা হয়েছে, তা একেবারেই অনভিপ্রেত। প্রসঙ্গত, বিদ্যালয়ে ভর্তির ফর্মে বা যে কোনও চাকরির আবেদনপত্রে ধর্ম কলমে ‘মনুষ্যত্ব’ বা ‘হিউম্যানিজম’ লেখার আইনি অধিকার আমাদের সকলের আছে।
তা ছাড়া, ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে ডি বসু, আই এ এস, বিশেষ সচিব, বিদ্যালয় শিক্ষা অধিকর্তাকে একটি নির্দেশ দেন, (No 1188-SE-(S) 10M-88/2002)। সেই নির্দেশনামায় জানানো হয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় ‘ধর্ম’ জানতে চাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। নিশ্চয় নার্সারি বিদ্যালয়ের জন্য আলাদা নির্দেশ নেই। প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সাল থেকেই আমাদের বিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনপত্রে ‘ধর্ম’ কলাম তুলে দেওয়া হয়েছে। ভর্তির আবেদনপত্রে ‘ধর্ম’ উল্লেখ করতেই হবে এমন কোনও সরকারি নির্দেশ না-থাকায় প্রায় দুই দশক আগেই আমরা তা করতে পেরেছিলাম।
এ বার পদবি প্রসঙ্গে জানাই, কোনও শিশুর জন্মের শংসাপত্রে যদি পদবি না-থাকে বা কোর্টে হলফনামা দিয়ে কেউ তার পদবি বর্জন করে, তা হলে বিদ্যালয় বা যে কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা তা মেনে নিতে বাধ্য থাকবে। উদাহরণস্বরূপ আমার এক বন্ধুর কথা উল্লেখ করতে চাই। তিনি প্রায় পঁচিশ বছর আগে আইনি ভাবে তাঁর পদবি ত্যাগ করেছেন। এখন তাঁর ব্যাঙ্ক আমানত, পাসপোর্ট, রেশন কার্ড মায় ভোটার তালিকাতেও শুধুই নাম আছে, পদবি নেই।
পরিশেষে জানাই, আজকের দিনেও অনন্যচেতার বাবা-মায়ের মতো উদারনৈতিক মুক্তচিন্তার অভিভাবকের বড়ই অভাব। তাদের আদর্শ নিয়ে বাঁচার সুযোগ আমাদেরই তৈরি করে দিতে হবে। প্রায় তিন দশক শিক্ষকতার পর আজ যদি খোঁজ পাই, ছাত্রীরা কেউ একজন অনন্যচেতার মায়ের মতো মা তৈরি হয়েছেন, তা হলেই আশার আলো দেখব। নইলে বড় হতাশা জাগবে।
বয়স নিয়ে
বয়স নিয়ে ঋজু বসুর লেখা (‘ইচ্ছাপূরণের নতুন গল্প...’, ১৪-৭) পড়ে মনে পড়ল এক মার্কিন অতিথির কথা। বেশ কয়েক বছর আগে রসায়নে নোবেল প্রাপক জোহান ডাইজেনহফারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল দুর্গাপুরে। মৃদুভাষী ডাইজেনহফারের উচ্চতার কাছে আমি নিতান্তই খর্বকায়। তার ওপর মৃদুভাষী। কাজেই অতি সন্তর্পণে কিছু কথা চালাচালি হল। তার মধ্যেই জানতে চাইলাম, ভারতে তো একাধিক বার এসেছেন, মার্কিন মুলুকের সঙ্গে মূলগত পার্থক্য বলতে কী নজরে এসেছে আপনার? দ্বিধাহীন কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললেন, ‘বয়স’।
আজ্ঞে?
এ বার অপেক্ষাকৃত উচ্চকণ্ঠে (তাঁর পক্ষে যতটা সম্ভব আর কী) বললেন, “ভারতে বড্ড বেশি বয়সকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ও দেশে সেটা হয় না।”
তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল, ভারতে বয়স্কদের যেমন সম্মান জানানো হয়, তেমনই জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে সরিয়েও ফেলা হয়। যেটায় তাঁর সমর্থন ছিল না।
আমাদের এক পরিবারের সদস্যকে দেখি, যিনি মননে যতটাই ঋদ্ধ ততটাই চঞ্চল। ইদানীং আমরা তাঁকে আর বাসে ট্রামে বাইরে যেতে দিচ্ছি না। তিনি সবে সাতাশিতে পড়েছেন। বছরখানেক আগেও তিনি বাৎসরিক পুরী ভ্রমণের প্রাক্কালে বাড়ি থেকে ভোর ছ’টায় বেরিয়ে টেরিটি বাজারে চিনে প্রাতরাশ সেরে ট্রেনে আসন সংরক্ষণের লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর চলাফেরায় বেড়ি পরানোয় তিনি যারপরনাই অখুশি।
ডাইজেনহফার জানতে পারলে হয়তো তিনিও অখুশি হতেন। কিন্তু কী আর করা। একটা সময় তো বয়সের ভার নামবেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.