করাচি টু জম্মু। ভায়া মুর্শিদাবাদ।
পাক ভূখণ্ড থেকে এ দেশের মাটিতে চোরাপথে জঙ্গি-চালানের জন্য এই ‘রুট’ও বেছে নিয়েছিল দাউদ-ঘনিষ্ঠ সৈয়দ আব্দুল করিম ওরফে টুন্ডা। অন্তত কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) এবং সিআইডি-র এমনই দাবি। গোয়েন্দাদের বক্তব্য: বছর পাঁচেক আগে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের চার ‘লিঙ্কম্যান’ মারফত টুন্ডা পাকিস্তানের এক লস্কর জঙ্গিকে জম্মুতে মোতায়েন করেছিল। আর গোটা পাচার-প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্বে ছিল তার শ্বশুর মহম্মদ জাকারিয়া ওরফে আবু তাহের, বিস্ফোরক চালানের আসামি হিসেবে যার ঠিকানা আপাতত কলকাতার জেল।
|
সৈয়দ আব্দুল করিম (টুন্ডা) |
শুক্রবার ভারত-নেপাল সীমান্তে টুন্ডাকে পাকড়াও করেছে দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল। কিন্তু টুন্ডার কার্যকলাপে পশ্চিমবঙ্গ-যোগের এ হেন তথ্য উঠে আসায় গোয়েন্দারা উদ্বিগ্ন। রাজ্যে এ ধরনের লস্কর-লিঙ্কম্যানদের হদিস পেতে এসটিএফ এখন তার মুখোমুখি বসতে চায়। সোমবার বিকেলে এসটিএফের একটি দলের দিল্লি যাওয়ার কথা। কাল, মঙ্গলবার তারা টুন্ডাকে জেরা করার চেষ্টা করবে। দাউদ-সঙ্গীর মুখ থেকে গোয়েন্দারা এ-ও বার করতে চাইবেন, সে কবে কোন জঙ্গিকে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে এ দেশে ঢুকিয়েছে। কিংবা কার কার মারফত বাংলাদেশ থেকে বিস্ফোরক পাঠিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।
টুন্ডা জম্মু পাঠিয়েছিল কাকে? এতে মুর্শিদাবাদের ভূমিকাই বা কী রকম?
এসটিএফ ও গোয়েন্দা-সূত্রের দাবি: ২০০৮-এ লস্কর-ই-তইবার সদস্য সিকন্দর আজম ওরফে রাজিন্দরকে নাশকতার উদ্দেশ্যে করাচি থেকে জম্মুতে পাঠিয়েছিল টুন্ডা। জাকারিয়ার ‘নেটওয়ার্ক’ কাজে লাগিয়ে প্রথমে তাকে মুর্শিদাবাদের বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢোকানো হয়। তাকে এক মাস ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রাখা হয় রঘুনাথগঞ্জের চার লিঙ্কম্যানের বাড়িতে। বিনিময়ে তারা দু’লাখ টাকা পেয়েছিল। শেষে সিকন্দর পাড়ি দেয় জম্মুতে। তবে সেখানে কোনও নাশকতা ঘটানোর আগেই সে ধরা পড়ে যায়, ২০০৮-এর জুলাইয়ে। তাকে জেরা করে হদিস মেলে রঘুনাথগঞ্জের দুই লস্কর-লিঙ্কম্যানের মহম্মদ মোস্তাক ও হাসানুজ্জামান ওরফে হাসান মাস্টার।
সিআইডি ওদের গ্রেফতার করে। পুলিশ জানায়, মোস্তাক-হাসানুজ্জামানের হেফাজতে প্রচুর বিস্ফোরক পাওয়া যায়। ও তারা স্বীকার করে যে, ভারতে নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যেই টুন্ডার নির্দেশে সেগুলো বাংলাদেশ থেকে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল।
মোস্তাক ও হাসান মাস্টারের বিচার চলছে জঙ্গিপুর আদালতে। বাকি দুই লিঙ্কম্যানের খোঁজ মেলেনি। অন্য দিকে সত্তরোর্ধ্ব টুন্ডার পঞ্চাশ বছর বয়সী শ্বশুর মহম্মদ জাকারিয়া ওরফে আবু তাহের বিস্ফোরক-সহ এসটিএফের জালে পড়েছে ২০০৯-এর ৬ মার্চ, শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে।
গোয়েন্দাদের দাবি: পশ্চিমবঙ্গ হয়ে ভারতের অন্যত্র লস্কর জঙ্গি ও বিস্ফোরকের ‘চালান’ পাঠানোয় টুন্ডার ডান হাত ছিল তার এই শ্বশুর। জাকারিয়া মূলত কাজটা করত বাংলাদেশে বসে। শিয়ালদহে পাকড়াও হওয়ার পরে নারকেলডাঙা থানায় তার নামে মামলা রুজু হয়। আপাতত প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি জাকারিয়ার বিচার চলছে শিয়ালদহ আদালতে, সম্প্রতি যার সাক্ষ্যদানপর্ব শেষ হয়েছে বলে এসটিএফ-সূত্রের খবর।
এ বার টুন্ডা-জাকারিয়া-মোস্তাক-হাসানুজ্জামানকে এক সূত্রে গেঁথে পশ্চিমবঙ্গে লস্কর-সক্রিয়তার একটা ছবি পেতে চাইছেন গোয়েন্দারা। এসটিএফের এক অফিসার রবিবার বলেন, “জাকারিয়া আমাদের কাছে কিছু তথ্য চেপে গিয়েছিল। আশা করছি, টুন্ডাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনাকে জোড়া দিতে পারব। দরকারে জেলে গিয়ে জাকারিয়াকে ফের জেরা করা হবে। মোস্তাক ও হাসান মাস্টারকেও ফের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।”
গোয়েন্দাদের বক্তব্য: ২০০৫-এ টুন্ডার সঙ্গে মোস্তাক ও হাসান মাস্টারের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল জাকারিয়াই। পরে টুন্ডার নির্দেশে সে ২০০৮-এর জুলাইয়ে দুই লিঙ্কম্যানকে বিস্ফোরক পাঠায়। শুধু তা-ই নয়, দুই লিঙ্কম্যানকে আইইডি তৈরির প্রশিক্ষণও দিয়েছিল জাকারিয়া। সে নিজে অবশ্য জামাইয়ের তালিমেই তাতে চোস্ত হয়ে উঠেছিল। প্রসঙ্গত, বোমা বাঁধতে গিয়ে সৈয়দ আব্দুল করিমের বাঁ হাত খোয়া যায়। সেই থেকে তার নাম টুন্ডা।
গোয়েন্দা-তথ্য বলছে, জাকারিয়ার জন্ম বিহারের কাটিহারে। পরে তার পরিবার উঠে আসে উত্তর দিনাজপুরের করণদিঘির বড়সোহার গ্রামে। কিষাণগঞ্জ ও বারাণসীতে পড়াশোনা সেরে জাকারিয়া করণদিঘির এক মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় যোগ দেয়। পুলিশ-সূত্রের খবর, ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে এলাকায় ‘প্ররোচনামূলক’ বক্তৃতা দিয়ে সে গোয়েন্দা-নজরদারির আওতায় আসে, একাধিক বার তাকে করণদিঘি থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ১৯৯৩-এ সে পালিয়ে যায় বাংলাদেশের রাজশাহিতে, এক তুতো ভাইয়ের আশ্রয়ে। কিন্তু জাকারিয়ার জঙ্গি-সংশ্রবের পত্তন হল কী করে?
পুলিশের দাবি: রাজশাহিতে জাকারিয়া এক মাদ্রাসায় শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছিল। মোস্তাকের মামাবাড়ি রাজশাহিতে, সেই সূত্রে মোস্তাকের সঙ্গে তার পরিচয়। আর ১৯৯৪-এ ওখানেই তার সঙ্গে দেখা হয় টুন্ডা ওরফে ‘বাবাজি’-র। দু’জনের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বাড়ে। ১৯৯৯-এ জাকারিয়াকে পাকিস্তানে ‘জেহাদি’ প্রশিক্ষণ নিতে পাঠায় টুন্ডা। প্রথমে ইসলামাবাদ-করাচি। ক’মাস বাদে লাহৌরের মুরিদকে-তে মাস চারেক ধরে জাকারিয়ার ‘ট্রেনিং’ হয়। প্রশিক্ষণ সেরে লাহৌরেরই এক মাদ্রাসার সে পড়াতে শুরু করে। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, টুন্ডার আরও ‘কাছের লোক’ হয়ে ওঠার উদ্দেশ্যেই নিজের আঠারো বছরের মেয়ে আসমার সঙ্গে তার বিয়ে দেয় জাকারিয়া।
টুন্ডার বয়স তখন ষাটের উপরে। |