|
|
|
|
উদ্ধার বেনামি পাকিস্তানি পাসপোর্ট |
নেপাল সীমান্তে পুলিশের জালে দাউদ ঘনিষ্ঠ টুন্ডা |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
২৬/১১-র জঙ্গি হানার পরে ২০ জন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গির তালিকা পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়েছিল ভারত। শুক্রবার রাতে সেই তালিকা থেকে প্রথম এক জন ধরা পড়ল নেপাল-ভারত সীমান্তে।
সৈয়দ আব্দুল করিম ওরফে টুন্ডা।
শুধু ২৬/১১ নয়, টুন্ডাকে ভারত খুঁজছিল গত দু’দশক ধরেই। দাউদ ইব্রাহিম ঘনিষ্ঠ এই জঙ্গিকে অবশেষে গ্রেফতার করল দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল। পুলিশের দাবি, গত কাল নেপাল-ভারত সীমান্তের বানওয়াসা-মহেন্দ্রনগর থেকে টুন্ডাকে গ্রেফতার করার সময় তার কাছে একটি পাকিস্তানি পাসপোর্ট পাওয়া যায়। সেখানে তার নাম ছিল আব্দুল কুদ্দুস। এ বছরই ২৩ জানুয়ারি তৈরি করা হয়েছিল সেটি। টুন্ডার ব্যাপারে এই বিষয়টিকেও মাথায় রেখে পাকিস্তানের উপর চাপ আরও বাড়ানোর কৌশল নিচ্ছেন সাউথ ব্লকের কর্তারা।
দাউদ ইব্রাহিম ছাড়াও লস্কর নেতা হাফিজ সইদ, জইশ-ই-মহম্মদ প্রধান মৌলানা মাসুদ আজহার, আজম চিমা, জাকিউর রহমান লকভি, বাবা সাহিব-সহ একাধিক প্রথম সারির জঙ্গি নেতার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ৭০ বছরের টুন্ডার আসল পরিচয়, সে একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। ১৯৯৩-এর মুম্বই বিস্ফোরণ থেকে ২৬/১১-র মুম্বই হামলা, সব মিলিয়ে অন্তত ৩৩টি মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত এই টুন্ডা। ২০১০ সালে কমনওয়েলথ গেমসের সময়ও দিল্লিতে বিস্ফোরণের ছক কষেছিল টুন্ডা। পুলিশ অবশ্য সে বার বানচাল করে দেয় চক্রান্ত। এ বার টুন্ডাকে হাতে পাওয়ার পরে লস্কর-সহ এ দেশে সক্রিয় অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলির কাজকর্ম সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা যাবে বলে আশা করছে পুলিশ। |
সৈয়দ আব্দুল করিম
বয়স ৭০
|
|
• নেপাল-ভারত সীমান্তে গ্রেফতার
• পাকিস্তানকে পাঠানো ভারতের ২০ জন
‘মোস্ট ওয়ান্টেড’-এর অন্যতম জঙ্গি
• দাউদ ইব্রাহিম ও লস্কর প্রধান হাফিজ সইদের ঘনিষ্ঠ |
|
• সঙ্গে ছিল সদ্য বানানো বেনামি পাক পাসপোর্ট
• অভিযুক্ত: ’৯৩ মুম্বই বিস্ফোরণ, ২০০১ সংসদ হানা,
২৬/১১ মুম্বই হামলা
• বোমা তৈরি করতে গিয়ে খোয়া যায় বাঁ হাত।
তার পর থেকেই নাম টুন্ডা |
|
দিল্লিতে জন্মে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের পিলাখুয়া এলাকায় থিতু হয়ে বসা সৈয়দ আব্দুল করিমের ‘টুন্ডা’ (হাতকাটা) হয়ে ওঠার কাহিনি যে কোনও সিনেমার গল্পের থেকেও বেশি রোমাঞ্চকর। সংসারের হাল ফেরাতে বাবার হাত ধরে লোহা, তামার মতো ধাতু গলানোর কাজ দিয়ে জীবন শুরু। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, সম্ভবত সেই সময়েই নানা ধরনের রাসায়নিকের ব্যবহার বুঝে যায় সে, যা পরবর্তী কালে তাকে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু ধাতু গলানোর কাজ বেশি দিন চালায়নি সে। একে একে ছুতোরের পেশা হয়ে ছাঁট মালের ব্যবসায়ী, তার পরে কাপড়ের ব্যবসা এবং সেখান থেকে সোজা জঙ্গি হয়ে ওঠা! গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের বক্তব্য, ১৯৮০-র দশকে এ দেশে আইএসআই প্রথম যে দলটিকে ছায়াযুদ্ধের জন্য নিয়োগ করে, সেই দলেই নাম ছিল আব্দুল করিমের। তখন তার বয়স প্রায় ৪০! তখনও সে ‘টুন্ডা’ হয়ে ওঠেনি। ১৯৮৫ সালে বোমা বাঁধতে গিয়ে উড়ে যায় বাঁ হাত। সেই থেকে তার আসল নাম ভুলে যায় অপরাধ জগৎ। আব্দুল করিমের নতুন নাম হয় টুন্ডা।
এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, “টুন্ডা সব সময় খুব নম্র ব্যবহার করত। বিনয়ী মানুষটিকে তাই কেউই সন্দেহের তালিকায় রাখত না।” ওই কর্তার আরও বক্তব্য, “টুন্ডা কখনওই লস্কর বা জামাত-উদ-দাওয়ার প্রথম সারির নেতা ছিল না। তবে সংগঠনের প্রায় সব চক্রান্তেরই খবর থাকত ওর কাছে। টুন্ডা আসলে ভবিষ্যতের জঙ্গিদের খুঁজে বের করে তাদের প্রশিক্ষণ দিত।” সহজলভ্য জিনিস যেমন, ইউরিয়া, নাইট্রিক অ্যাসিড, পটাশিয়াম ক্লোরাইড, নাইট্রোবেঞ্জিন এমনকী চিনি দিয়ে কী ভাবে বিস্ফোরক বানানো যায়, উঠতি জঙ্গিদের তা শেখাত সে। সেই সঙ্গে জনবহুল এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কী ভাবে এক সঙ্গে অনেক লোককে হত্যা করা যায়, তারও প্রশিক্ষণ দিত।
আশির দশকে জঙ্গি জীবনে নাম লেখালেও ১৯৯৩-এর মুম্বই বিস্ফোরণের আগে তার নাম সে ভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। ওই বিস্ফোরণের তদন্তে নেমেই গোয়েন্দারা জানতে পারেন টুন্ডার কথা। দাউদ ইব্রাহিমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এই লোকটি কিন্তু মুম্বই বিস্ফোরণের বছর দু’য়েক আগেই এ দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল বলে গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের দাবি। সন্দেহ, সে তখন থেকেই পাকিস্তানে। সেখান থেকেই একের পর এক বিস্ফোরণে নেতৃত্ব দেওয়া। মাথায় ডি-কোম্পানির হাত। ’৯৩-এ মুম্বইয়ের পরে হায়দরাবাদ, গুলবর্গা, সুরাত, লখনউয়ে বিস্ফোরণে তার হাত ছিল বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা। তার পরে ’৯৬ থেকে ’৯৮-এর মধ্যে দিল্লি, পানিপথ, লুধিয়ানা, কানপুর, বারাণসী বিস্ফোরণেও সেই টুন্ডা। সহযোগিতায় দাউদের ডি-কোম্পানি। কিন্তু কোনও বারই পুলিশ নাগাল পায়নি তার। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বাংলাদেশ থেকে এক বার খবর আসে, টুন্ডা মারা গিয়েছে। বহু খোঁজ করেও সে খবরের সত্যতা জানা যায়নি। ২০০০ সাল নাগাদ গোয়েন্দারা ধরেই নেন, টুন্ডার মৃত্যুর খবর সত্যি। খোঁজ-পর্বে খানিক রাশ আলগা করেন গোয়েন্দারা। পাঁচ বছর পরে এক জঙ্গিকে জেরা করে ফের নড়েচড়ে বসে পুলিশ। সে বছর অগস্ট মাসে দুবাই থেকে এক লস্কর জঙ্গিকে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশের স্পেশ্যাল সেল। তার থেকেই জানা যায়, টুন্ডা জীবিত। কিন্তু তাতে কী? টুন্ডা অধরাই। ২০০৬ সালে কেনিয়ায় টুন্ডাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে খবর মিললেও তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গিয়েছিল।
গোয়েন্দাদের বক্তব্য, দীর্ঘদিন করাচি, কেনিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করেছিল টুন্ডা। সম্প্রতি পুলিশের কাছে খবর আসে, বেশ কিছু দিন ধরে নেপালে আস্তানা গেড়েছে সে। নেপালে বসে ভারতীয় নোট জাল করে তা খড়িবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশে পাচার করছে। ওই কাজে বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গেও তার যোগাযোগ রয়েছে।
সেই খবর পেয়েই টুন্ডাকে ধরতে অভিযানে নামে দিল্লি পুলিশের দল। ১৯৯৬ সালে রেড কর্নার নোটিসে টুন্ডার একটি ছবি প্রকাশ করেছিল ইন্টারপোল। পুলিশ জানিয়েছে, ওই ছবির ভিত্তিতেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুক্রবার বিকেল ৩টে নাগাদ টুন্ডাকে গ্রেফতার করে তারা। প্রথমে সে পরিচয় অস্বীকার করে। কিন্তু পরে পুলিশের জেরার মুখে ভেঙে পড়ে। মেনে নেয় পরিচয়। তার পর শনিবার সকালে দিল্লি এনে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করানো হয়। তাকে তিন দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট।
এ দিন টুন্ডাকে গ্রেফতার করা নিয়ে পুলিশের বক্তব্যেও ধন্দ রয়েছে। একটি সূত্রে শোনা যাচ্ছে, উপসাগরীয় দেশ থেকে তাকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। অন্য এক পক্ষের বক্তব্য, দিন দশেক আগে করাচি ছাড়ে টুন্ডা। তার পর দুবাই হয়ে কাঠমান্ডু আসে। গোয়েন্দারা তার গতিবিধির উপর নজর রাখছিলেন। তাঁরাই দিল্লি পুলিশের স্পেশ্যাল সেলকে খবর দেন। তার পরেই ভারত-নেপাল সীমান্ত থেকে ধরা হয় টুন্ডাকে।
টুন্ডার গ্রেফতারের খবরে সাউথ ব্লকের মতোই খুশি ছড়িয়েছে হাপুরে তার পরিবারেও। ভাই থেকে শ্যালিকা সকলেই চান কড়া শাস্তি। কারণ? এই একটি লোকের জন্যই গত প্রায় দু’দশক ধরে তাঁদের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। শ্যালিকা তাহিরার কথায়, “আগেও বহু বার শুনেছি, ও ধরা পড়েছে। কিন্তু তা হয়নি। এ বার আমরা খুশি। চাই কঠোরতম সাজা হোক ওর।” |
|
|
|
|
|