মার্সিডিজ না মোষ, গল্প গজব সে আজব মেলায়
স সওদা সে ম্যায় বহুত খুশ হুঁ...।
ভগৎ সিংহের ছবিতে যেমন দেখা যায়, অনেকটা সে রকম গোঁফ। মাথায় মিলিটারি ধাঁচের টুপি। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল বাহাদুর সিংহ। পঞ্জাবের জালন্ধর থেকে এসে মেলা থেকে ২৫ লক্ষ টাকায় একটি মোষ কিনেছেন। কেনাকাটা সেরে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে আয়েশ করে বসেছেন চা খেতে। তেল চকচকে গোঁফে তা দিয়ে বড় কাচের গেলাসের দুধ-চায়ে চুমুক মেরে তৃপ্তিটা প্রকাশ করলেন।
তত ক্ষণে মোষটিকে লরিতে তোলার তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। মাদী মোষ, নাম গঙ্গা। কালো চকচকে শরীর। মাথায় লাল তিলক। ২২ থেকে ২৮ লিটার দুধ দেয়। বাহাদুরের কর্মচারীরা গঙ্গাকে দড়িতে বেঁধে ফেলেছেন। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটি মাঝারি মাপের লরি।
কত দাম পড়ল? বাহাদুর গর্বিত স্বরে বললেন, ২৫ লক্ষ!
“২৫ লক্ষ? ওই টাকায় তো মার্সিডিজ বেঞ্জ কেনা যায়! তার বদলে মোষ?” অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন বাহাদুর সিংহ। ক্যামেরা মোষের কাছ থেকে প্যান করে আপাতত সিংজির মুখে। সিংজি হাসতে হাসতে বলছেন, “মার্সিডিজ তো খরচ। আর ‘গঙ্গা’ তো আমার ইনভেস্টমেন্ট।’’ জালন্ধরে বাহাদুরের ডেয়ারির ব্যবসা। ‘গঙ্গা’কে সেখানে আরও যত্ন করে খাইয়েদাইয়ে ওর দুধ বাড়ানো হবে। বাহাদুরের কাছে অঙ্কটা পরিষ্কার “আমি জানি ‘গঙ্গা’ আমার কাছে থাকলে ৩০ লিটার দুধ দেবে। কমপক্ষে পাঁচটা বাচ্চা দেবে। সেগুলোও দুধ দেবে। দরকার হলে তাদের বিক্রি করব।”
হিসারের মেলায়। —নিজস্ব চিত্র
বাহাদুর একা নন। ঠা ঠা রোদ্দুর ঠেলে ছোটু সিংহ সেকেন্ডারি স্কুলের মাঠ-ভর্তি লোক। হাতে লাঠি। মাথায় রঙিন পাগড়ি। হাঁটু পর্যন্ত ধুতি। পায়ে ধূলিধূসর নাগরা। ভরদুপুরে এঁরা সব উজিয়ে এসেছেন গরু-মোষের বাজারে। ২-৩ লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে ২৬-২৭ লক্ষ টাকায় পর্যন্ত গরু-মোষের দাম। মোষের মধ্যে সবচেয়ে দামি মুররা প্রজাতির মোষ, যার দুধ উৎপাদনের ক্ষমতা সব চেয়ে বেশি। বিহারের বিখ্যাত শোনপুরের মেলাতেও গরু-মোষের ঢালাও বিকিকিনি হয়। কিন্তু সেখানে এই মাত্রায় দর ওঠে না। মহারাষ্ট্র বা গুজরাতে ডেয়ারির ব্যবসার রমরমা আছে। গরু-মোষের বাজার সেখানেও বসে। কিন্তু রোহতক বা হিসারের মতো মেলা চরিত্রে তবু স্বতন্ত্র।
কেন? রোহতকের বাসিন্দা কাপুর সিংহ দু’বছর আগে দু’লক্ষ ৫০ হাজার টাকায় একটি মোষ কিনেছিলেন। তার নাম লক্ষ্মী। তারপর হরিয়ানার পশুপালন দফতরের সাহায্যে লক্ষ্মীকে আরও নধর করে তোলা হয়। নানা ধরনের প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পায় লক্ষ্মী। কোথাও তিন লক্ষ টাকা। কোথাও পাঁচ লক্ষ টাকা। কয়েক দিন আগে অন্ধ্রের এক কৃষক এসে রোহতকের একটি বাজার থেকে ২৫ লক্ষ টাকায় লক্ষ্মীকে কিনে নিয়ে গিয়েছেন।
হরিয়ানার ডেয়ারি এবং পশুপালন শিল্প এইখানেই মহারাষ্ট্র বা গুজরাতের চেয়ে আলাদা। ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় দুগ্ধ সরবরাহকারী দেশ। আর ভারতের মোট দুধের শতকরা ৫৫ শতাংশ উৎপাদন করে হরিয়ানা। এখানে আমূলের মতো কোনও সমবায় আন্দোলন হয়নি। গত দু’দশকে হরিয়ানা ডেয়ারি এবং পশুপালনের যে প্রসার, তার পিছনে সরকারি-বেসরকারি দু’রকম উদ্যোগই রয়েছে। হরিয়ানার রাজ্য কৃষি বিপণন বোর্ড গরু-মোষের প্রতিপালনে বড় ভূমিকা নেয়। আবার বহু বেসরকারি সংস্থাও রয়েছে, যারা গরু-মোষের চাষ করে। সেই সঙ্গে রয়েছে সাবেকি ভূস্বামীদের মধ্যে সামন্তবাদী জীবনধারা আর পুঁজির বিকাশের এক আশ্চর্য মেলবন্ধন। বলিউডের ছবিতে দেখা পঞ্জাব-হরিয়ানার গ্রাম আর পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ছবি ঠিক যে রকম হয়!
রোহতকে বড় বড় শপিং মল আছে। সিনেমাপ্লেক্স, ফার্মহাউস আছে। রাস্তায় বড় বড় গাড়ি। পথচলতি মেয়েদের পাঁচ আঙুলে পাঁচ রঙের নেলপালিশ। আর তার সঙ্গেই রয়েছে গরু-মোষের মেলা। দেবীলাল যখন উপপ্রধানমন্ত্রী, তখন এ রাজ্যে এসে দেখেছিলাম তিনি নিয়মিত ঘন সর দেওয়া দুধ আর আফিম সেবন করতেন। দিল্লিতে প্রেসিডেন্ট এস্টেটে থাকার সময় একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গোশালা তৈরি করেছিলেন। লালুপ্রসাদ যাদবের সঙ্গে এটাই তফাৎ! লালুর গরুরা কিন্তু গোয়ালেই থেকে গিয়েছিল!
দেবীলাল-ভজনলাল-বংশীলাল-চৌটালা থেকে আজ হরিয়ানার রাজ্যপাটে ভূপিন্দর সিংহ হুডা। গুড়গাঁওয়ের অটো-হাবের পাশাপাশি আরাবল্লি পর্বতমালার পাশে শুষ্ক মরুভূমি-সম প্রান্তরে এই সময়ের মধ্যে কিন্তু দুগ্ধ বিপ্লবও হয়ে গিয়েছে। সেই বিপ্লবের কাণ্ডারী এ রাজ্যের ধনী ‘কুলাক’রা। তাঁরা সামন্ত-সংস্কৃতি আর পুঁজি অর্থনীতি, দুয়েরই পূজারী। তাই এঁরা মার্সিডিজ কেনেন না, ট্র্যাক্টরে চেপে বাজারে আসেন। ২৫ লক্ষ টাকা গরু-মোষে ‘ইনভেস্ট’ করেন।
এ কোনও গফুর মিঞার কাহিনি নয়। বাহাদুরের ‘গঙ্গা’ কোনও ‘কালাপাহাড়’ও নয়। ভূমিসংস্কার হওয়া বাংলায় এ দৃশ্য বিরল! সে-কালে কমলাকান্ত বলতেন, “দুধ যে খায়, গরু তার।” প্রসন্ন গোয়ালিনী তীব্র প্রতিবাদ করত। হরিয়ানার বাহাদুর সিংহ আর প্রসন্নর মধ্যে কয়েক আলোকবর্ষের দূরত্ব।
হিসারের মেলায় প্রসন্নদের জায়গা নেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.