বধূ নির্যাতনের উৎসে রয়েছে অসুস্থ শৈশব, বলছে সমীক্ষা
রাবেয়া বিবি। বামুনগাছি থেকে লোকের বাড়ি কাজ করতে আসেন কলকাতা। সংসারে কোনও সাহায্য করেন না পেশায় রাজমিস্ত্রী স্বামী। ছেলে মেয়ে নিয়ে রাবেয়ার সংসার চলে তার একার উপার্জনেই। অথচ যখন তখন স্বামীর কাছে মার খাওয়া থেকে শুরু করে মদের টাকা জোগানো, রাবেয়ার দৈনন্দিনের বাস্তবতা।
উত্তর কলকাতায় ধনী শ্বশুরবাড়িতে স্বামী, সন্তান ‘ভরপুর’ সংসার শিখার। মেয়ে পড়াশোনা করে কলকাতার দামি স্কুলে। এত প্রাচুর্য সত্ত্বেও প্রতি রাতে মদ্যপ স্বামীর মার শিখার জীবনের অঙ্গ। তবু বিয়ে ভেঙে স্বাধীন ভাবে নিজের মতো করে বাঁচার কথা ভাবতে পারেন না শিখা।
দক্ষিণ কলকাতার একটা ফ্ল্যাটে একাই থাকেন উদ্ধৃতি। বিয়ে করেছিলেন তাঁরই সহপাঠীকে। প্রথম দিকে সব ঠিকই ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তার উপর যৌন জুলুম শুরু হল। প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন উদ্ধৃতি। তার পরে এক দিন জানতে পারলেন তাঁর স্বামী শিশুনিগ্রহেও জড়িয়ে পড়েছেন। উদ্ধৃতির কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না তখন, তাই মেনে নিয়েছিলেন তখনকার মতো। ক্রমশ আর সহ্য করতে না পেরে ডিভোর্স করার আবেদন করেছেন আদালতে।
বিবাহিত জীবনে মারধর, যৌন অত্যাচারের শিকার হচ্ছে দেশের ৩৫ শতাংশ বিবাহিত মেয়েই। কিন্তু সব রাজ্যেই এই ছবিটা এক নয়। কোথাও বেশি, কোথাও কম। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ৩৮ শতাংশ মেয়ে বিবাহিত জীবনে শারীরিক বা যৌন নিগ্রহের শিকার।
কী ধরনের পরিস্থিতিতে বিবাহিত জীবনে অত্যাচারের সম্মুখীন হন মেয়েরা, কাদের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ঝুঁকি বেশি, তা নিয়ে সম্প্রতি দেশের চারটি রাজ্য, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, বিহার ও ঝাড়খণ্ড নিয়ে একটি সমীক্ষা হয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা ও সাক্ষরতার মাপকাঠিতে বিহার ও ঝাড়খণ্ডের চেয়ে অনেকটাই উন্নত তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্র। দেখা যাচ্ছে, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের প্রায় ৫৬ শতাংশ মহিলা যেখানে বিয়ের পরে অত্যাচারিত হন, যেখানে মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুতে এই সংখ্যাটা ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ বিবাহিত জীবনে কোনও মেয়ে অত্যাচারিত হবেন কিনা, তা অনেকটাই নির্ভর করে তাঁর বা তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা ও শিক্ষার উপর।
কোন মেয়েদের ঝুঁকি বেশি
• নিজের শৈশবে যারা মা-কে
অত্যাচারিত হতে দেখেছে
• যাদের স্বামী মদে আসক্ত

• যাদের পুত্রসন্তান হয়নি
• স্বামীর চাইতে যাদের বয়সের ফারাক অনেকটা
• যাদের শিক্ষা, রোজগার কম
সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ছোট থেকেই যারা পারিবারিক হিংসার দৃশ্য দেখে বড় হয়, বিবাহিত জীবনে তারাই মারধরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বাবা মাকে মারছে, এই দৃশ্য দেখে বড় হয়ে ওঠা কারও কাছে স্ত্রীকে মারধর করা খুব স্বাভাবিক। উল্টো দিকে, এমন দৃশ্য দেখে বড় হয়ে ওঠা কোনও মেয়ের কাছে স্বামীর কাছে মার খাওয়ার ঘটনা মেনে নেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি থাকে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, কৃষি ক্ষেত্রে জড়িত মেয়েরা যত সহজে বিয়ের পরে স্বামীর মারের ব্যাপারটি মেনে নেন, অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে জড়িত মেয়েরা ততটা মানেন না। আবার পুত্র সন্তান না হলেও মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে মারধর খেতে বাধ্য হয় মেয়েরা। ওই গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের পার্থক্য খুব বেশি হলে যৌন অত্যাচারের সম্মুখীন হন মেয়েরা। বেশির ভাগ সময়েই অবাঞ্ছিত ভাবে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে মেয়েটি। সম্মুখীন হয় অন্যান্য যৌন সমস্যারও। সারা ভারতে ১৮টি রাজ্যে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার মহিলার উপর সমীক্ষা করেছিল একটি চিকিৎসা সংস্থা। দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৪০ শতাংশ মহিলাই স্বীকার করেছেন বিয়ের পরে স্বামীর কাছে শারীরিক ভাবে নিগৃহীত হন তাঁরা। বিয়ের পরে ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে যেতে বাধ্য হন দেশের বিবাহিত মেয়েদের দশ ভাগের এক ভাগ।
সমীক্ষাতে আরও দেখা যাচ্ছে, স্বামীদের মদ খাওয়ার সঙ্গে বধূ নির্যাতনের সম্পর্ক খুব স্পষ্ট। মদ খেয়ে বউকে মারা বা জোর করে যৌন সম্পর্কে বাধ্য করার ঘটনা ঘটছে অনেক ক্ষেত্রে। আর পণের জন্য স্ত্রীকে মারধরের ঘটনা তো রয়েইছে।
অন্য দিকে বধূর পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলক ভাল হলে, মেয়েটি পড়াশোনা জানলে বিবাহিত জীবনে মার খাওয়ার ঝুঁকি অনেক কম থাকে তার। আর্থিক স্বনির্ভরতাও বিয়ের পরে অত্যাচারিত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি মেয়েটির পরিবারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা না থাকে, তা হলে অবস্থার তফাত খুব বেশি হয় না। বিবাহিত মেয়েদের উপর অত্যাচার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কাজ করেছেন নন্দিতা ধাওয়ান। তিনি জানান, বিবাহিত জীবনে নির্যাতন যে শুধু গ্রামীণ মহিলাদের বাস্তবতা, তা নয়। শহরের মেয়েরাও এর শিকার। ধনী, দরিদ্র সব স্তরের মেয়েরা বিয়ের টিকিয়ে রাখতে চায়। তাই যত কষ্টই হোক, নির্যাতন মেনে নেয়। বিয়ে ভেঙে দিলে সমাজ কী বলবে, তা নিয়েও দ্বিধা থাকে। তবু দেখা যাচ্ছে, নিজেদের মতো করে প্রতিবাদের চেষ্টা করছেন মেয়েরা। কেউ সংসারে থেকে, কেউ বা বেরিয়ে এসে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.