সেনা-পুলিশের মিলিত অভিযানে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃস্থানীয় বেশ কয়েক জন নিহত হলেও রণে ভঙ্গ দিচ্ছে না তারা। চার দিনের বিক্ষোভ কেড়ে নিয়েছে আটশোরও বেশি মানুষের প্রাণ। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নতুন করে নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছে মিশর সরকার।
এর মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট মহম্মদ এলবারাদেই দেশ ছেড়ে অস্ট্রিয়া চলে গিয়েছেন বলে খবর মিলেছে সরকারি সংবাদমাধ্যম সূত্রে। তাঁর পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়ার পরেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। মুরসির কট্টর সমালোচক এলবারাদেই বলেছেন, “এক ফোঁটা রক্তপাতের জন্যও আমি নিজেকে দায়ী করতে পারব না।” বিক্ষোভ দমনে বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত নন তিনি। |
কোয়েত্তা শহরে বিক্ষোভ মুরসি সমর্থকদের। রবিবার। ছবি: এএফপি। |
মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হাজেম বেবলাউই জানিয়েছেন, “যাদের হাত রক্তাক্ত, তাদের সঙ্গে বোঝাপড়ার কোনও প্রশ্ন নেই। ওরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, অগুনতি মানুষকে মেরেছে।” তাই মন্ত্রিসভা আইনি পথে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছে। হাজেমের মতে, “শুক্রবারটা খুব খারাপ ছিল। থানা, মন্ত্রী বিক্ষোভকারীদের আক্রমণ থেকে বাদ যায়নি কেউই। পরিস্থিতি খুবই খারাপ।” যদি বেবলাউইয়ের প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়, তা হলে গোপন আস্তানায় ঘাঁটি গাড়তে হবে মুসলিম ব্রাদারহুডকে। দলটি যে সব জায়গা থেকে অর্থসাহায্য পায়, সেনা-পুলিশের নিশানা হতে হবে তাদেরও।
তবে ব্রাদারহুডের নিষিদ্ধকরণ নতুন কোনও ঘটনা নয়। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মুরসির ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম ব্রাদারহুড কিন্তু বরাবর নিষিদ্ধই ছিল। ১৯৫৪ সালে মিশরের সামরিক সরকার তাদের নিষিদ্ধ করেছিল। সম্প্রতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা নিজেদের নথিভুক্ত করেছিল। মুবারক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে ১৯২৮-এ প্রতিষ্ঠিত এই দলটি মুবারক পতনের পর থেকে হওয়া সব ক’টি নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল।
মিশর সরকারের পাশে থাকুন দেশের এই হিংসাত্মক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে এই অনুরোধ জানানো হচ্ছে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের তরফে। এই সূত্রে সাম্প্রতিক বিক্ষোভের ছবি এবং ভিডিওর একটি মন্তাজ দেখিয়েছেন মিশরের বিদেশ মন্ত্রকের সদস্যরা। তাতে জঙ্গিদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন তাঁরা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও মুরসি সমর্থকদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মিশরের অন্তর্বর্তী সরকারের অভিযোগ। আমেরিকা সামরিক সাহায্য করে বলে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে মিশর প্রশাসনের বক্তব্য, বিক্ষোভের পরিস্থিতিতে ওই সাহায্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। কিন্তু আমেরিকার মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ই ইউ) এ দিন জানিয়েছে, মিশরের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখতে চায় তারা। অন্তর্বর্তী সরকার এবং সেনাই এই হিংসা বন্ধে দ্রুত সক্রিয় হোক বলছে ই ইউ। রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেই এ দিন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পুনর্বিচার মুলতুবি হয়ে গিয়েছে। ২৫ অগস্ট ফের শুনানি হবে বলে জানিয়েছে কোর্ট।
সরকার নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবলেও দমছে না মুসলিম ব্রাদারহুড। ‘সামরিক অভ্যুত্থান বিরোধী জোট’ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, মুরসিকে ক্ষমতায় না ফেরালে কায়রোয় আরও বেশ কয়েকটি মিছিল হবে। যে কারণে শহরের মোড়ে মোড়ে ফের কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দক্ষিণ কায়রোয় সুপ্রিম কনস্টিটিউশনাল কোর্ট ভবনের বাইরে সশস্ত্র যান এবং সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে। তবে দিনের শেষ বেলায় দু’টি মিছিল বাতিল করে দিয়েছে ব্রাদারহুড। তবে তাদের সমর্থনে বিভিন্ন দেশে চলছে বিক্ষোভ।
কিছুটা হলেও রবিবার থেকে রাজধানী ছন্দে ফিরেছে। রাস্তাঘাটে সেনার টহল চোখে পড়লেও বুধবারের পরে এত দিনে খুলেছে ব্যাঙ্ক আর
স্টক এক্সচেঞ্জ।
তবে এখনও সন্ধে ঘনালেই আরব দুনিয়ার অন্যতম প্রাণবন্ত শহরটি যেন ভুতুড়ে কোনও শহর। নীল নদের তীর থেকে উধাও সব নৌকা। মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেনা। মুরসি নিয়ে প্রশ্ন করলে যারা নিরুত্তর। সন্ধ্যা থেকে ভোর জারি থাকছে কার্ফু। বড় বড় রাস্তায় ট্যাঙ্ক। অলি গলি আনাচে কানাচে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সেনারই লোক পাহারায়। কয়েক রাত আগেই যারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি ভবনে আক্রমণের ছক কষেছিল, এমন ৪৭ জন ব্রাদারহুড সমর্থককে ধরেছে এই ছোট দলগুলি।
ক্রমাগত এই ধরপাকড়, লুঠপাট আর রক্তপাত ফের শহরটাকে গ্রাস করছে দেখে সাধারণ এক ডিম বিক্রেতার প্রশ্ন, “মুবারকের সময়ে জীবন কঠিন ছিল। এখন জীবন আরও অসহ্য। সন্ধের পরে কোনও বিক্রিবাটা নেই। এ ভাবে কী করে বাঁচব? এর নাম কি জীবন?” |