ভয়শূন্য রহমান

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য
উচ্চ যেথা শির...

এই রবীন্দ্র-কবিতা নিয়ে এ বার গান গাইলেন এ আর রহমান। হ্যাঁ, গাইলেন। আবৃত্তি করেননি। এম টিভির কোক স্টুডিয়ো সিজন থ্রিয়ের জন্য। সঙ্গে কলকাতার শুচি। শুচিস্মিতা দাস।
কবিতাটির হিন্দি তর্জমা করেছেন প্রসূন জোশী। বাংলা কবিতার লাইনগুলোর সঙ্গে ভেসে আসে হিন্দি লাইনগুলো। সঙ্গে শুচির গান। ব্লাজের র‌্যাপ। আর শিবমণির কংখোল।
ইউ টিউবে যে মুহূর্তে ‘জাগাও মেরে দেশ কো’ ভিডিয়োটি আপলোড করা হয়, তখন থেকেই প্রচুর কমেন্টস। কেউ বলছেন খুব ভাল। ছিদ্রান্বেষীরা বলছেন— রহমানের উচ্চারণে গণ্ডগোল।
তবে শুচি এমন একটা কাজ করে দারুণ খুশি। শুধু এটা নয়। স্বয়ং জাভেদ আখতার রাজি হয়েছেন শুচির প্রথম হিন্দি গানের অ্যালবামের কথা লিখে দিতে। আর লতা মঙ্গেশকর শুচির গান শুনে এতটাই মুগ্ধ যে তাঁকে নিয়োগ করেছেন নিজের পুণে সঙ্গীত অ্যাকাডেমির শিক্ষিকা হিসেবে।
রহমানের সঙ্গে শুচির প্রথম দেখা হয় নিউ জার্সিতে। সেখানে তাঁর গান শুনেই রহমান তাঁকে হলিউডের একটি প্রজেক্টে রেফার করেছিলেন। সেই সিনেমার নাম ছিল ‘বেস্ট এক্সটিক মেরিগোল্ড হোটেল’। সুরকার ছিলেন থমাস নিউম্যান। সিনেমাটির সঙ্গীত মনোনয়ন পেয়েছিল গোল্ডেন গ্লোবেও।
এ বছর জুলাই মাসের শেষ দিকে শুচি পুণেতে গিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকরের বিশ্বশান্তি সঙ্গীত কলা অ্যাকাডেমিতে। ফেরার পথে হঠাৎ রহমানের অফিস থেকে ফোন চেন্নাই চলে আসার জন্য। পরের দিন সকালে চেন্নাই পৌঁছন শুচি। “চেন্নাইতে রহমান স্যারের বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া স্টুডিয়ো। নাম পঞ্চথান। এই গানটা করার সময় প্রায় বারো-তেরো দিন স্যারের সঙ্গে কাটিয়েছি। আট দিন চেন্নাইতে। তার পর মুম্বইতে,” বলছেন তিনি।

এ আর রহমানের সঙ্গে শুচি
শুচির ভাষায় রহমানের স্টুডিয়ো নাকি অনেকটা চিড়িয়াখানার মতো দেখতে। “পৃথিবীর হেন বাদ্যযন্ত্র নেই যা ওখানে পাওয়া যাবে না। অ্যাকোয়াস্টিক যন্ত্র হোক কী ইলেকট্রনিক। ওখানে সব রয়েছে। আর স্যার যখন কি-বোর্ড নিয়ে বসেন মনে হয় যেন সাক্ষাৎ ভগবান।”
রহমান কাজ করেন সারারাত ধরে। আর সেই একই ভাবে এই গানেও কাজ হল। “লোকে বলে স্যার খুব কম কথা বলেন। আমার কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য অভিজ্ঞতা হল। উনি বেশ আড্ডাবাজ। মনে আছে প্রসূন জোশী আমাকে স্টুডিয়োতে এসে বলেছিলেন, ‘শুচি, ভেবে দেখো তুমি বাঙালি হিসেবে এই কাজটা করবে কি না। রহমান তামিল। আমি উত্তর ভারতের মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কলকাতায় সবাই খুব স্পর্শকাতর। একটু ভুল হলে ওখানে কেউ তোমাকে ছেড়ে দেবে না’। এই নিয়ে স্যারও আমাকে বলেছিলেন। তবে তাতে আমার আরও জেদ চেপে গিয়েছিল যাতে কাজটা নিখুঁত ভাবে করতে পারি।”
অন্যান্য মহড়ার সময়, রহমান থাকেন কনসোলে। আর গায়কেরা থাকেন রেকর্ডিং রুমে। “পওয়াইতে ওঁর স্টুডিয়োতে টানা আঠারো ঘণ্টা রিহার্সালের শেষে যখন সবার ছুটি হয়ে যায়, তখন আমাকে উনি ডেকে বলেন শুচি তোমার এখনও ছুটি হয়ে যায়নি। এখন তোমাকে আমার বাংলা উচ্চারণের শিক্ষক হতে হবে। ভয়ে ভয়ে বলি, স্যার ভুল হলে বলব তো? উনি আমায় বলেন আমার ছোট ভুল হলেও তুমি তা ঠিক করে দেবে। আরও বলেন যে এ ক্ষেত্রে তুমি থাকবে কনসোলে, আর আমি থাকব ভেতরে। রাত শেষ হয়ে ভোর হয়ে যায়, আমাদের কাজ চলতে থাকে। স্যারের রবিঠাকুরের প্রতি অপার ভালবাসা, শ্রদ্ধা আরও গাঢ় হয়ে ফুটে ওঠে। প্রতিটা শব্দ সঠিক ভাবে উচ্চারণ করার অদম্য প্রচেষ্টা। একজন তামিল ভদ্রলোকের পক্ষে বাংলা উচ্চারণ করা সহজ নয়। হয়তো ‘উচ্চ’-র বদলে ‘উচো’ হয়ে গিয়েছে। সেটা ঠিক না হলেও, ‘দিবসশর্বরী’ শব্দটার উচ্চারণটা শেষে ঠিক করে ফেলেছিলেন,” হেসে হেসে বলেন শুচি।
মুম্বইতে শ্যুটিং হয়েছিল। ভোর ছ’টা পর্যন্ত রিহার্সাল করে দশটা থেকে আবার শ্যুটিং। “মজার ব্যাপার হল, অন্যান্য শিল্পী ওঁর সঙ্গে গেয়ে তার পর হলিউডে গাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আমি ঠিক তাঁর উল্টো। তবে এটা বলব যে ওঁর কাজের সঙ্গে আমি হলিউডের কাজের ধারার মিল পেয়েছি,” বলছেন শুচি।


লতাজির মুখে শুনেছি যে উনি ইউটিউবে আমার সব গান শুনেছেন। পুণেতে ওঁর গুরুকুলে
গান শেখানোর দায়িত্ব দিয়েছেন আমাকে। জাভেদ আখতার আমার হিন্দি অ্যালবামের
কথাগুলো লিখেছেন। এই কিংবদন্তি শিল্পীদের সান্নিধ্যে এসে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে নিজেকে
টেলিভিশন আর ইউটিউবে গানটা শোনার পরে অবশ্য কেউ কেউ রহমানের উচ্চারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ বলছেন যে কপিরাইট উঠে যাওয়ার কুফল হল রবিঠাকুরের কবিতা নিয়ে এই রকমের পরীক্ষানিরীক্ষা। সব শুনে এই অভিযোগের উত্তরে শুচি বলছেন, “আমি স্যারকে বলেছিলাম যে এটা কিন্তু গান নয়, কবিতা। উনি তার উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমার এখানে কবিতা থেকে গান হতে সময় লাগে না।’ আর যাঁরা স্যারের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পড়াশোনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের বলছি এই কবিতার ইংরেজিটা উনি জানতেন এবং লাইনগুলো ওঁর জীবনদর্শনের সঙ্গে মিলেছিল বলেই তার বাংলা তর্জমাটা আমার কাছে চেয়েছিলেন। স্যার যে কতটা অল্প সময়ের মধ্যে চেষ্টা করে এ ভাবে এত কঠিন বাংলা ভাষাটা শিখেছেন সেটাই আমাদের তুলে ধরা উচিত। যেটুকু ত্রুটি কারও চোখে পড়ছে, সেটা আরও সময় পেলে উনি নিশ্চয়ই ঠিক করতেন।”
এ দিকে জাভেদ আখতার শুচির অ্যালবামের জন্য তিনটে গান লিখেছিলেন। আরও চারটে গান লেখা বাকি। “গানের কথা লিখতে যাওয়াটা একটা অভিজ্ঞতা। একদিন ওঁর বাড়িতে গিয়েছি আমার সুর শোনাতে। হঠাৎ উনি বললেন, আমি একটু ঘুমিয়ে নিই? আমি ভাবছি কী করব। উনি বললেন বসে থাকতে। পনেরো মিনিট পর আবার ফিরে এসে কী অসাধারণ মুখড়াটা লিখলেন। শঙ্কর মহাদেবন আর আমি মিলে এই গানটা ইতিমধ্যে রেকর্ড করেছি। সামনেই সেটা মুক্তি পাবে। পরের গানটি গাইব হরিহরণের সঙ্গে।”
তবে সব থেকে বড় অভিজ্ঞতা হল যখন লতা মঙ্গেশকরের বাড়ি থেকে ফোন আসে তাঁর কাছে। “বলা হল পেডার রোডের বাড়িতে আসতে। সেখানে গিয়ে লতাজির মুখে শুনলাম যে উনি ইউ টিউবে আমার সব গান শুনেছেন। গল্প শুনতে চাইলেন কেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান সাব-এর গান আমাকে এত উদ্বুদ্ধ করে। ওঁর পায়ের কাছে বসে বললাম সেই সাত বছর বয়সে বাবা আমাকে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান সাব-এর একটা ক্যাসেট কিনে দিয়ে শুনতে বলেছিলেন। রাগ দরবারি শুনে আমি মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। বাচ্চারা রাতে খেলনা নিয়ে শোয়। আমি ওই ক্যাসেটটা নিয়ে শুতাম।”
এর কিছু দিন পর পুণেতে ডাক আসে শুচির। “এ ভাবে গান শেখাতে চাইনি কোনও দিন। তবে এ রকম একটা বাড়ি থেকে দায়িত্ব পাওয়াটাই সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে একটা বড় পাওনা। জীবনে আর কী কী পাওয়ার আছে জানি না। তবে এই সব কিংবদন্তি শিল্পীর সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে।”

রবির আলোয়
নতুন কিছু মানেই তা খারাপ নয়। তবে পরীক্ষা সবার জন্য নয়। রহমান ঈশ্বরের সন্তান। উনি যা করবেন সেটাকে বাতিল করা যাবে না। রহমান করেছেন বলেই দল বেঁধে পরীক্ষা করলে নাম হবে না
রহমানের কাজটা হৃদয়স্পর্শী হলে আপত্তি কোথায়? দেখা দরকার গানটায় কবিতার স্পিরিটটা আছে কি না। উচ্চারণ নিয়ে বলব, কে এল সায়গলের উচ্চারণে ত্রুটি থাকলেও ওঁর গান দারুণ লাগে
পরীক্ষায় আপত্তি নেই। তবে কবিতাটা পড়ে গায়ে যে ভাবে কাঁটা দেয়, গানটার থেকেও তা পেতে চাই। রহমানের গানটা লাউঞ্জ মিউজিক মনে হয়েছে। উচ্চারণের বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।
রহমান তো একটা নতুন গান তৈরি করেছেন। অ্যারেঞ্জমেন্টটা খুবই ভাল লেগেছে। কিছু কিছু জায়গাতে রহমানের বাংলা উচ্চারণ বুঝতে অসুবিধে হলেও সামগ্রিক ভাবে প্রচেষ্টাটা ভাল লেগেছে



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.