আঁচ একটা ছিলই। মঙ্গলবার তারই বহিঃপ্রকাশ দেখল খয়রাশোল।
এলাকার প্রভাবশালী নেতা অশোক ঘোষের খুনের জেরে তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিক্ষোভের মুখে পড়তে দেখে তাই অবাক হননি দলেরই জেলা নেতৃত্বের একটা বড় অংশই। তাঁরা বলছেন, জেলায় দলের একটা বড় অংশের কর্মী-সমর্থকদের মনে ক্ষোভের বীজ পুঁতেছে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর লোকজনই। যার মূলেই আছে, পুরনো নেতা-কর্মীদের খাটো করে সিপিএম-ফব-কংগ্রেস ছেড়ে দলে যোগদান করা লোকেদের দলের বড় বড় পদে জায়গা করে দেওয়া। আর এ ক্ষেত্রে তৃণমূলের পুরনো নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশই বিক্ষুব্ধ হয়ে দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরোধিতায় নেমেছেন। যার জেরে নানুরের পরে জেলার আরও একটি ব্লকে শাসক দলের ওই প্রভাবশালী নেতার ঢোকা কার্যত বন্ধ হয়ে গেল মনে করছে এলাকার মানুষ।
তৃণমূলেরই একটি সূত্রের খবর, দীর্ঘদিনের রাজনীতির কারবারি অশোক ঘোষের গোটা খয়রাশোল ব্লকেই ব্যাপক প্রভাব ছিল। গত লোকসভা ভোটের আগে তিনি সদলবলে তৃণমূলে যোগ দেন। |
খয়রাশোলে শিল্পমন্ত্রীর গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে জনতা। |
তখনও কিন্তু তৃণমূলে অশোক মুখোপাধ্যায়ের (বর্তমানে যিনি দলের খয়রাশোল ব্লক সভাপতি) তেমন উত্থান হয়নি। অশোক ঘোষের ডান হাত ছিলেন আনিসুর রহমান। যিনি খয়রাশোলের একটি প্রান্তের তৃণমূলের বড় সংগঠক ছিলেন। গত বছর মে মাসে খয়রাশোলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তৃণমূলেরই তিন নেতা-কর্মী খুন হয়েছিলেন। তাঁদেরই মধ্যে ছিলেন সেই আনিসুর। তাঁর খুনের কিছুক্ষণ আগেই খুন হয়েছিলেন অশোক মুখোপাধ্যায়-গোষ্ঠীর নেতা গোলাম সাব্বির কাদেরি। ওই ঘটনার আগে থেকেই খয়রাশোল ব্লকের দায়িত্ব কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে দুই অশোকের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। কিন্তু অশোক ঘোষ দলের জেলা সভাপতির বিরোধী-গোষ্ঠীর নেতা স্বপনকান্তি ঘোষের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় অশোক মুখোপাধ্যায়কেই ওই ব্লকের দায়িত্ব দেন অনুব্রত। অশোক ঘোষের হাত থেকে পদ ছিনিয়ে নেওয়ায় ওই এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব আরও তীব্র আকার নেয়। প্রকাশ্যে একে-অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে দেখা যায় দুই নেতাকেই।
গেল পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে জেলা তৃণমূলের শীর্ষনেতাদের অনুরোধে দলের স্বার্থে তাঁরা একে অপরকে সাহায্য করতে রাজি হন বলেও খবর। কিন্তু এখানেও আসন সমঝোতা নিয়ে দু’পক্ষের বিরোধ বাধে। পরে অবশ্য দু’জনের চেষ্টায় খয়রাশোলে ভাল ফল করে তৃণমূল। অনুব্রত বিরোধী গোষ্ঠীর এক প্রভাবশালী নেতার কথায়, “তৃণমূলের জেতা ১০টি পঞ্চায়েতের ৮টিই অশোক ঘোষের অবদানে। ব্লক সভাপতি অশোক মুখোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা কার্যত প্রায় কিছুই নেই। তাঁর মাথায় অনুব্রত মণ্ডলের হাত ছিল বলেই এত বাড়বাড়ন্ত।” |
ক্ষোভের চিত্র ধরা পড়ল সিউড়িতেও। মঙ্গলবার তোলা —নিজস্ব চিত্র। |
ভোট মিটতেই অশোক ঘোষ নিজের সংগঠন বাড়ানোর কাজে মন দেন। তৃণমূলের অন্দরের খবর, এর জেরেই বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছিলেন অশোক মুখোপাধ্যায়। অশোক ঘোষের প্রভাবকে ভাল ভাবে নিতে পারেননি দলের ওই বর্তমান ব্লক সভাপতি। তার উপরে তৃণমূলের জেতা ৮টা পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদে জেতা প্রার্থীদের উপরে কর্তৃত্ব ছিল অশোক ঘোষেরই। ফলে দু’পক্ষের বিরোধ তীব্র হয়। তৃণমূল সূত্রেই জানা গিয়েছে, ভোটের পরে সেই বিরোধ মেটাতে অশোকবাবু খুন হওয়ার ঠিক আগের দিনই অর্থাৎ রবিবার খয়রাশোলেই দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসেন অনুব্রত ও মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ। ঠিক হয়, জেলা সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দুই অশোক মিলেই ঠিক করবেন, কোন পঞ্চায়েতে কে প্রধান হবেন। অশোক ঘোষের অনুগামীরা মনে করছেন, যেহেতু খয়রাশোলের ১১০টি পঞ্চায়েত আসনের ৬৮টিতেই অশোক ঘোষের অনুগামীরা জিতেছিলেন, তাই ওই সিদ্ধান্তের পরে কার্যত পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল অশোক মুখোপাধ্যায়ের। তাই দলের জেলা সভাপতির এই নির্দেশ পছন্দ হয়নি অশোক মুখোপাধ্যায়ের। যার জেরে ঠিক তার পরের দিনই খুন হতে হল দলেরই প্রাক্তন ব্লক সভাপতিকে বলে তাঁদের দাবি।
এ দিকে অশোকবাবুর খুনের পিছনে পুলিশ-প্রশাসন ও এলাকার মানুষ অন্য একটি প্রেক্ষিতের কথাও বলছেন। তাঁদের দাবি, যে ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে দুই অশোকের এত লড়াই, তা আসলে খয়রাশোলের অবৈধ কয়লা ব্যবসাকে ঘিরেই। খয়রাশোল ব্লকে ঝাড়খণ্ড ও অজয় নদ পেরিয়ে আসা অবৈধ কয়লার রমরমা দীর্ঘদিনের। এ ছাড়াও কাঁকরতলা থানা এলাকায় গড়ে ওঠা একটি খোলামুখ কয়লাখনির কর্তৃত্ব ও তোলা আদায়ও এই খুনের অন্যতম কারণ হতে পারে বলে পুলিশের একটি সূত্রের অনুমান। কারণ পঞ্চায়েত যার হাতে থাকবে, এলাকার কর্তৃত্বও কার্যত তারই হাতে। |
|
|
দুপুর ১.১৩: সিউড়ি হাসপাতালে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে
বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। খয়রাশোলে
বাইরে তখন বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন কয়েকশো কর্মী-সমর্থক। |
বিকেল ৩.১৬: পার্টি অফিসের ভিতরে
কার্যত বন্দি হয়ে থাকলেন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী। |
|
বিকেল ৩.২২: ঘণ্টা দু’য়েক পরে জনতার প্রতিবাদের মাঝখান দিয়েই পার্থবাবুকে
বের
করে নিয়ে যাচ্ছেন সিউড়ির বিধায়ক স্বপন ঘোষ ও অন্য নেতা-কর্মীরা। |
|
ফলে অবৈধ কয়লা ও খনিও স্বাভাবিক ভাবেই সেই গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। সে কারণেই দুই নেতার দ্বন্দ্ব এত মরিয়া আকার নেয়। তৃণমূলের অনুব্রত-বিরোধী গোষ্ঠীর ওই নেতার অভিযোগ, “এলাকার দখল নিয়ে দু’জনের মধ্যে গণ্ডগোল তো চলছিলই। আসলে এলাকার কয়লা মাফিয়াদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে দলেরই কিছু লোক অশোক ঘোষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলেন।”
এ দিকে এ দিন সকাল থেকেই খয়রাশোলের কেন্দ্রগড়িয়ায় নিহতের বাড়িতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন পরিবারের লোকজন। বাড়ির পুরুষেরা ও স্থানীয় দলীয় কর্মীদের একাংশ তখন ময়না-তদন্তের পরে হাসপাতাল থেকে অশোকবাবুর দেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সিউড়িতে ছিলেন। বেলা ১১টা নাগাদ বোলপুরে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয় থেকে খয়রাশোলের নেতা-কর্মীদের কাছে খবর আসে মৃতদেহ গ্রামে ঢোকার পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও কেন্দ্রগড়িয়া আসবেন। বিকেল চারটে নাগাদ অশোকবাবুর দেহ কেন্দ্রগড়িয়ায় পৌঁছলেও বিক্ষোভের জেরে বিব্রত পার্থবাবু আর অশোকবাবুর বাড়িতে যাননি। বাড়িতে নিয়ে আসার আগে অবশ্য অশোকবাবুর দেহ কেন্দ্রগড়িয়া হাইস্কুল (অশোকবাবু এই স্কুলেরই করণিক ছিলেন) ঘুরে পৌঁছেছে। সেখান থেকে নিয়ে গেলে মৃতদেহটি আর বাড়ির ভেতরে ঢোকানো হয় না। বাড়ির বাইরেই রাখা হয় অশোকবাবুর নিথর দেহ। মৃতদেহের উপরে আছড়ে পড়েন নিহতের মেয়ে সোমা ঘোষ, স্ত্রী বিজয়া ঘোষ। স্ত্রী বলেন, “আমরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম। একটা আশঙ্কা ছিল। সেটাই সত্যিই হয়ে গেল।” মেয়ে সোমা বলেন, “রাজনীতির আমরা এত কিছু বুঝি না। বাবাকে আমরা রাজনীতি করতে বারণ করতাম।” কান্নার রোল আরও তীব্র হয়। অশোকবাবুর দেহ দেখতে প্রায় গোটা গ্রাম ভেঙে পড়ে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই সেই দেহ নিয়ে চলে যাওয়া হয় বক্রেশ্বরে। সেখানেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় খয়রাশোলের ওই প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার। |
ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় ও দয়াল সেনগুপ্ত |