দয়াল সেনগুপ্ত • খয়রাশোল |
ভাস্করজ্যোতি মজুমদার • সিউড়ি |
খয়রাশোলে দলের প্রভাবশালী নেতা অশোক ঘোষকে খুনের ঘটনা ঘিরে মঙ্গলবার তৃণমূলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বেনজির চেহারা দেখল বীরভূম। দেখলেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। নিহত নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এ দিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দু’-দু’বার তুমুল বিক্ষোভের মুখে পড়েন পার্থবাবু। ক্ষিপ্ত জনতা শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে থাকা বীরভূম জেলার তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের গাড়িতে ভাঙচুরও চালায়। বিক্ষোভকারীদের তাড়া খেয়ে পার্থবাবুকে ফেলেই পালিয়ে যান অনুব্রত। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, খয়রাশোলে দলেরই একটি দফতরে প্রায় দু’ঘণ্টা আটকে থাকতে হয় শিল্পমন্ত্রীকে। এবং সেই সময়ে ওই দফতরটির পাশের ব্লক তৃণমূল অফিসটিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। অস্বস্তি বাড়িয়ে নিহত নেতার ছেলে এ দিন তাঁর বাবাকে খুনের জন্য সরাসরি অভিযোগের আঙুল তুলেছেন অনুব্রতর দিকে। |
খয়রাশোলে নিহত তৃণমূল নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে সিউড়ি সদর হাসপাতালে বিক্ষোভের মুখে
শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় |
দিনের শেষে অবশ্য অশোকবাবুর খুন ও পার্থবাবুকে ঘিরে বিক্ষোভের সঙ্গে দলের কোনও যোগ নেই বলে দাবি করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তিনি বলেন, “দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে এই খুন হয়নি। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে প্রাথমিক ভাবে আমি জেনেছি, ঘটনার সঙ্গে আমাদের দলের কোনও যোগ নেই। সঠিক তদন্ত হলে খুনি ধরা পড়বেই।” একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “যারা বিক্ষোভ দেখিয়েছে, তারা কেউ আমাদের দলের সদস্য নয়।”
সোমবার খয়রাশোলে খুন হন তৃণমূলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি অশোক ঘোষ। তাঁর মৃত্যুর খবর আসতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন এলাকার তৃণমূল কর্মীরা। তাঁর অনেকেই আঙুল তোলেন অনুব্রতর বিরুদ্ধে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে বোলপুরের কসবা অঞ্চলে নির্দল প্রার্থী (বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) হৃদয় ঘোষের বাবাকে খুনের ঘটনায় ইতিমধ্যেই নাম জড়িয়েছে অনুব্রতর। পাশাপাশি উস্কানিমূলক মন্তব্য করার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করার নির্দেশও দিয়েছে আদালত। তার পরেও পঞ্চায়েত নির্বাচনে বীরভূমে দলের বিপুল জয়ে স্বস্তি ফিরেছিল অনুব্রত-শিবিরে। কিন্তু অশোক ঘোষের হত্যাকাণ্ড ফের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল অনুব্রত ও তাঁর অনুগামীদের।
মঙ্গলবার নিহত নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে প্রথমে সিউড়ি এবং পরে খয়রাশোলে যান শিল্পমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গেই ছিলেন অনুব্রত-সহ জেলার একাধিক তৃণমূল নেতা। ১টা ৫ মিনিট নাগাদ হাসপাতালে ঢোকে পার্থবাবুর গাড়ি। পিছনের গাড়িতেই ছিলেন অনুব্রত এবং আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি বিকাশ রায়চৌধুরী। ঠিক তার পরের গাড়িতে লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম। পার্থবাবু, অনুব্রত, মনিরুলরা গাড়ি থেকে নামতেই সেখানে উপস্থিত কয়েকশো তৃণমূল কর্মী-সমর্থক ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ‘পুলিশের উপরে আমাদের ভরসা নেই, অশোকবাবুর খুনের সিবিআই-সিআইডি তদন্ত হোক’ স্লোগান ওঠে। দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের জেরেই অশোকবাবুকে খুন হতে হয়েছে বলেও আওয়াজ ওঠে। বিক্ষোভকারীদের একাংশ এই খুনে অনুব্রত ও অশোক মুখোপাধ্যায় (খয়রাশোলের ব্লক সভাপতি) জড়িত বলেও চিৎকার করতে থাকেন। |
শোকে ভেঙে পড়েছেন নিহত অশোক ঘোষের মেয়ে। খয়রাশোলের কেন্দ্রগড়িয়ায়। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত |
বিক্ষোভের চেহারা দেখে পার্থবাবু দৃশ্যতই অস্বস্তিতে পড়েন। অনুব্রত হাত দেখিয়ে বিক্ষোভকারীদের থামানোর চেষ্টা করলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সিউড়ির তৃণমূল বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষ ও কয়েক জন কোনও রকমে পার্থবাবুকে বিক্ষোভকারীদের থেকে আড়াল করার চেষ্টা করেন। তাঁরাই পরে ব্যারিকেড করে মৃতদেহের সামনে পৌঁছে দেন পার্থবাবু, অনুব্রতদের।
নিহত নেতার দেহে মালা দিয়ে সাংবাদিকদের পার্থবাবু বলেন, “গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই হোক বা দুষ্কৃতীদের দ্বারাই হোক, মূল কথা হল তৃণমূল কর্মীদের মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হচ্ছে। এর কোনও রাজনৈতিক উত্তর নেই। অন্য উত্তর আছে।” কী সেই উত্তর, তা অবশ্য তিনি খোলসা করেননি। দেড়টা নাগাদ হাসপাতাল ছেড়ে পার্থবাবু, অনুব্রত, মনিরুলরা খয়রাশোলের উদ্দেশে রওনা দেন। তার মিনিট দশেকের মধ্যেই অশোকবাবুর দেহ নিয়ে খয়রাশোলের উদ্দেশে রওনা দেন স্বপনবাবুরাও।
দুপুর আড়াইটে নাগাদ খয়রাশোলে তৃণমূল কার্যালয়ে (নিহত নেতা এখানেই বসতেন) ঢোকেন পার্থবাবু। কিন্তু পার্টি অফিসের অদূরে আটকে দেওয়া হয় অনুব্রতর গাড়ি। শতাধিক তৃণমূল কর্মী অনুব্রতর গাড়ি ঘিরে প্রথমে বিক্ষোভ দেখান পরে ইট-পাটকেলও ছোড়েন। গাড়িতে থাকা অনুব্রতকে এলাকার নেতাদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, “এটা কী হচ্ছে! সামলাও!” ওই নেতারা তখন অনুব্রতকে চলে যেতে বলেন। বেগতিক বুঝে পার্থবাবুকে ফেলে রেখেই অনুব্রত কার্যত পালিয়ে যান সেখান থেকে।
অনুব্রত চলে গেলে বিক্ষোভের মাঝে পার্টি অফিসেই আটকে পড়েন পার্থবাবু। তার মধ্যেই একশো মিটার দূরে তৃণমূলের ব্লক কার্যালয়ে (অশোক মুখোপাধ্যায়ের অফিস) আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় দু’ঘণ্টা বন্দি হয়ে থাকায় পার্থবাবু অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। তবু সেখানেই তিনি দেখা করেন নিহতের ভাই দীপক ঘোষ ও ছেলে বিশ্বজিতের সঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার আশ্বাসও দেন। এর পরে বিক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকদের বুঝিয়ে পার্থবাবুকে বাইরে নিয়ে আসেন সিউড়ির বিধায়ক-সহ কয়েক জন। নিহতের বাড়িতে গেলে বিক্ষোভের মুখে পড়তে পারেন, এই আশঙ্কায় পার্থবাবুকে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেননি স্থানীয় নেতৃত্ব। দুপুর সাড়ে ৩টে নাগাদ খয়রাশোল ছাড়েন পার্থবাবু।
বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ অশোকবাবুর দেহ কেন্দ্রগড়িয়ায় তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। নিহতের স্ত্রী বিজয়া ঘোষ বলেন, “সব সময় ভয়ে থাকতাম। মানুষটা সেই খুনই হয়ে গেল!” ছেলে বিশ্বজিৎ বলেন, “পার্থবাবুকে এ দিন কিছু বলার তেমন সুযোগ পাইনি। তবে, অশোক মুখোপাধ্যায়, অনুব্রত মণ্ডলদের মতো নেতারা যেন ছাড়া না পায়, তা মুখ্যমন্ত্রীকে বলব!” এ প্রসঙ্গে মুকুল রায়ের মন্তব্য, “একটা মানুষ খুন হয়েছেন। সেখানে তাঁর প্রিয়জন অভিযোগ করতেই পারেন। সেই অভিযোগ নিয়েও তদন্ত হবে।”
খয়রাশোলে শাসকদলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশের বক্তব্য, এই খুনের পিছনে দলেরই দ্বন্দ্ব রয়েছে। গত বছর মে মাসে দুবরাজপুরে খুন হন অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা গোলাম সাব্বির কাদেরি। ওই খুনের কিছুক্ষণের মধ্যেই দুবরাজপুর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে নিহত অশোক ঘোষের ঘনিষ্ঠ, অনুব্রত-বিরোধী হিসেবে পরিচিত দুই তৃণমূল নেতা-কর্মী আনিসুর রহমান এবং সুখেন্দু সরকারকে গুলি করে খুন করা হয়। নিহত তিন জনেরই বাড়ি খয়রাশোল এলাকায়। তখনও দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের দিকেই আঙুল উঠেছিল। তৃণমূল সূত্রেই জানা যাচ্ছে, বর্তমান ব্লক সভাপতি অশোক মুখোপাধ্যায়ের (অনুব্রত-অনুগামী) জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে। অশোক ঘোষের প্রভাব এলাকায় বাড়ছিল। এটা নিয়ে দুই গোষ্ঠীর লড়াই চলছিলই।
|
বাবা বলেছিল, আমি হয়তো আর বেশি দিন না-ও থাকতে পারি। অনুব্রত, অশোকরা (মুখোপাধ্যায়) আমাকে মারার জন্য লোক লাগিয়েছে। বিশ্বজিৎ ঘোষ
নিহত নেতার ছেলে |
|
এ দিন তৃণমূলের স্থানীয় এক নেতা বলেন, “অবৈধ কয়লার কারবার নিয়ে দলেরই দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াইটা সাংঘাতিক জায়গায় পৌঁছেছে খয়রাশোলে। ফলে, অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিটা তৈরি হয়েই ছিল। অশোক ঘোষের মতো জনপ্রিয় নেতা খুন হয়ে যাওয়ায় এলাকার লোকজন ক্ষোভে ফেটে পড়েছে।” বস্তুত, তিনি যে খুন হতে পারেন, সেই আশঙ্কা পরিবারের কাছে কিছুদিন আগেই করেছিলেন অশোক ঘোষ। তাঁর বছর বাইশের ছেলে বিশ্বজিৎ বলেন, “দিন কুড়ি আগে সন্ধ্যায় বাবা বাড়ি ফিরেই আমাকে ডেকে নেন। বাড়ি ঢুকতেই বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি হয়তো আর বেশি দিন না-ও থাকতে পারি। অনুব্রত, অশোকরা (মুখোপাধ্যায়) আমাকে মারার জন্য লোক লাগিয়েছে। আমি না থাকলে তুই মা আর বোনকে দেখিস।”
বিশ্বজিতের দাবি, “ওই অশোক মুখোপাধ্যায় আর অনুব্রত মণ্ডলই চক্রান্ত করে বাবাকে খুন করিয়েছেন। আমরা ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।” বীরভূমের পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মা বলেন, “এখনও পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ জমা পড়েনি। তবে পুলিশ চার জনকে আটক করেছে।” সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাতেই থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে অশোকবাবুর পরিবার।
সন্ধ্যায় বোলপুরে দলীয় কার্যালয়ে বসে অনুব্রত বলেন, “অশোক ঘোষ দলের পুরনো কর্মী। তাঁর এবং অশোক মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ওই এলাকায় পঞ্চায়েত ভোটে আমরা ব্যাপক সাফল্য পেয়েছি। এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত আমরা চেয়েছি। পুলিশ সুপারের সঙ্গে কয়েক বার কথা বলেছি। ওই এলাকায় আমাদের একাধিক নেতা-কর্মী খুনের ঘটনায় পাণ্ডবেশ্বরের কয়লা মাফিয়াদের জড়িয়ে থাকার বিষয় উঠে আসছে।” পুলিশ এই ঘটনায় যে চার জনকে আটক করেছে, তাদের দু’জন বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বরের বাসিন্দা। পুলিশের দাবি, খুনের ঘটনার আধ ঘণ্টা পরে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে খয়রাশোল থেকে পাণ্ডবেশ্বর যাওয়ার পথে ওরা আটক হয়। বাকি দু’জন খয়রাশোলের বাসিন্দা। |