ক্রমশ কঠোর হচ্ছে রাজ্য। প্রত্যাশিত সাড়া মিলছে না কেন্দ্রের কাছ থেকেও। এই পরিস্থিতিতে পাহাড় ক্রমশ অস্বস্তি বাড়াচ্ছে বিমল গুরুঙ্গের।
টানা বন্ধে বিপর্যস্ত পাহাড়ে জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ-প্রশাসনের তরফে যে এ বার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মধ্যেই কেন্দ্রের কাছে বারবার আর্জি জানিয়েও এখনও তাদের দাবি নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে সাড়া না পেয়ে বেশ চাপে মোর্চা নেতৃত্ব। এমনই যে, বৃহস্পতিবার দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করেছেন মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ। এখানেই শেষ নয়। মোর্চার অস্বস্তি বাড়িয়ে এ দিনই কলকাতা হাইকোর্ট মদন তামাং হত্যা মামলায় অভিযুক্ত পাঁচ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা সমর্থককে দার্জিলিং আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করার নির্দেশ দিয়েছে।
দার্জিলিং নিয়ে রাজ্য যে চুপ করে থাকবে না, তা গোড়াতেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে নানা মামলায় অভিযুক্ত ২৪ জন মোর্চা সমর্থককে পুলিশ গ্রেফতার করে রাজ্যের কড়া মনোভাবেরই বার্তা দেওয়া হয়েছে। আজ মহাকরণে স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যাঁরা অশান্তি ছড়াচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুরনো মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করতে বলা হয়েছে।” ‘গোর্খাল্যান্ড পার্সোনেল’ বা জিএলপি-র বিরুদ্ধেও যে রাজ্য প্রয়োজনে কড়া হবে, তা-ও এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন বাসুদেববাবু। এ সবের পাশাপাশিই পাহাড়ে অশান্তির মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিচ্ছে রাজ্য সরকার। তার মধ্যে যেমন পাহাড়ে পুলিশ-প্রশাসনের শূন্যপদ পূরণের বিষয়টি রয়েছে, তেমনই পুলিশের গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো বা বকেয়া টাকা মিটিয়ে দেওয়ার মতো বিষয়গুলিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে রাজ্য। |
এ সবের পাশাপাশিই গুরুঙ্গদের উপর চাপ আরও বাড়িয়ে মোর্চা-ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেও কড়া পদক্ষেপ করতে চলেছে সরকার। অভিযোগ, সমতলের এক শ্রেণির ব্যবসায়ী রাতের অন্ধকারে নানা ভাবে চাল-ডাল-আলু ইত্যাদি পাহাড়ে পৌঁছে বাড়তি ফায়দা তোলার চেষ্টা করেন। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই সমতলের এক ব্যবসায়ীর গুদামে হানা দিয়ে তল্লাশি চালিয়ে মজুত খাদ্যশস্যের পরিমাণ পরীক্ষা করে অনেক অসঙ্গতি মিলেছে। ওই ব্যবসায়ীকে সতর্ক করা হয়েছে। আরও দু’জনের খাদ্যশস্যের গুদামে নজর রাখা হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। কালোবাজারির মাধ্যমে বিপুল মুনাফা করার পাশাপাশিই ওই ব্যবসায়ীরা বন্ধকেও দীর্ঘায়িত করছেন বলে অভিযোগ পুলিশের। মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিনয় তামাং অবশ্য বলেন, “এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ। পাহাড়ে যেখানে প্রচুর পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন, সেখানে খাবার আনলে সকলেরই নজরে পড়ত। আমাদের এখানে যা খাবার মজুত রয়েছে, তা যথেষ্ট। সমতল থেকে আনার দরকার নেই। কোথাও কালোবাজারি হচ্ছে জানলে আমরাই ব্যবস্থা নেব।”
মোর্চার অস্বস্তি বাড়িয়েছে কেন্দ্রের মনোভাবও। রাহুল গাঁধীর সঙ্গে দেখা করার সময় চেয়েও সাড়া পাননি গুরুঙ্গরা। পরিস্থিতি বুঝে এ দিন প্রস্তুতি নিয়েও দিল্লি যাওয়ার পরিকল্পনা স্থগিত করে দেন মোর্চা সভাপতি। তাঁরা অবশ্য এখনও মহাকরণকে এড়িয়ে দিল্লিতেই রফা সূত্র খোঁজার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ দিন রোশন গিরি-সহ দিল্লিতে মোর্চার প্রতিনিধিরা দেখা করেন বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা অরুণ জেটলির সঙ্গে। পরে তাঁরা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আর পি এন সিংহের সঙ্গেও দেখা করেন। পরে রোশন গিরি বলেন, “বিজেপি আমাদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল।” কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও তাঁদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি উপর মহলে জানানোর আশ্বাস দিয়েছেন বলে দাবি মোর্চা নেতৃত্বের। রোশন গিরি জানান, তাঁরা কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ-সহ আরও কয়েক জন শীর্ষ নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
তবে রাজ্য সরকার যে মোর্চা নেতাদের সঙ্গে এখনই কোনও আলোচনায় বসতে রাজি নয়, তা এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। এ দিন তিনি সরকারি কর্মচারীদের কাজে যোগ দেওয়ার উপরেও জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন,“যে প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, আমরা তার কঠোর নিন্দা করছি। স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে কলকাতা হাইকোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে, সবাইকে তা মান্য করার অনুরোধ জানাচ্ছি।” এর পরেই মুখ্যসচিব বলেন, “যদি সে সবের তোয়াক্কা না করা হয়, তা হলে কঠোর পদক্ষেপ করা হবে।”
পুলিশ-প্রশাসনের এই কঠোর অবস্থানের মুখে স্থানীয় সরকারি কর্মীদের মধ্যে ‘গোর্খাল্যান্ড-আবেগ’কেই উস্কে দিতে চেয়েছেন মোর্চা নেতৃত্ব। পুলিশ এবং রাজ্য সরকারের গ্রামীণ পুলিশ কর্মীদের উদ্দেশে বিনয় তামাং এ দিন বলেন, “দার্জিলিঙের যাঁরা পুলিশে কাজ করবেন, যদিও তাঁরা রাজ্য সরকারের কাজ করেন, তবু তাঁদের গোর্খাল্যান্ডের প্রতি দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা রয়েছে।” এ দিনই গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে ফের গায়ে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেন এক মোর্চা সমর্থক। জেলাশাসকের বাংলোর সামনে এই ঘটনা ঘটে। তবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত মোর্চার অন্য সমর্থকেরা দ্রুত আগুন নিবিয়ে ফেলেন। ওই মোর্চা সমর্থককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মোর্চা নেতাদের উপর আরও চাপ বাড়িয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের এ দিনের নির্দেশ। বৃহস্পতিবার মদন তামাং হত্যায় অভিযুক্ত পাঁচ মোর্চা সমর্থককে দার্জিলিং আদালতে ১৪ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করতে করেছে হাইকোর্ট। নিম্ন আদালত এই পাঁচ জনকে অর্ন্তবর্তী জামিন দিয়েছিল। মদন তামাঙের স্ত্রী ভারতী তামাং ওই জামিন খারিজ করার আবেদন জানিয়ে মামলা করেন।
|