গুরুঙ্গের মুখে ফিরে এল জিটিএ-র কথা
যিনি জিটিএ-কে নস্যাৎ করে দিয়ে গোর্খাল্যান্ডের দাবি তুলেছেন, সেই বিমল গুরুঙ্গের মুখেই বুধবার আবার ফিরল গোর্খা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অথরিটি-র কথা। এ দিন, পাহাড়ে অনির্দিষ্টকালের বন্ধের পাঁচ দিনের মাথায় সিংমারিতে সাংবাদিক সম্মেলনে জিটিএ-র প্রতি রাজ্যের বঞ্চনার অভিযোগ তুলে ক্ষোভে উগরে দিলেন তিনি। মোর্চা সভাপতি বলেন, “রাজ্য বলছে জিটিএ-কে অনেক সাহায্য করা হয়েছে। অথচ, আজও বিধানসভায় জিটিএ-র জন্য বাজেট পেশ করে অনুমোদন করানো হয়নি। এমনকী, যে পরিমাণ টাকা আমাদের দেওয়া হবে বলা হয়েছে, তার পুরোটা এখনও দেওয়া হয়নি। এটা মেনে নেওয়া যায় না।” একই সঙ্গে ইঙ্গিত দিলেন, পাহাড়বাসী চাইলে মোর্চা বন্ধ প্রত্যাহার করার পথেও হাঁটতে পারে।
মোর্চার বিক্ষোভ এড়াতে হেঁটে জেলাশাসকের দফতরে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রসচিব। ছবি: রবিন রাই।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ দিনই রাজ্যের তরফেও আলোচনার ইচ্ছে দেখানো হয়েছে। এ দিন শিলিগুড়িতে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে বসিয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব বলেছেন, “আলোচনার টেবিলে বসাই যেতে পারে। গণতন্ত্রে আলোচনার দরজা কখনও বন্ধ হয় না।” দু’দিন আগে রাজ্যের তরফে বলা হয়েছিল, বন্ধ না তুললে কোনও আলোচনা নয়। সেই শর্ত কি বহাল রাখা হচ্ছে? মন্ত্রীর মন্তব্য, “না, আমরা পাহাড়ে শান্তি ও জনজীবন স্বাভাবিক রাখার জন্য আলোচনার ক্ষেত্রে আগাম শর্ত রাখতে চাই না।” গুরুঙ্গ যে রাজ্যের বঞ্চনার কথা বলেছেন, তা অবশ্য মানছে না সরকার। পাহাড় থেকে নামার আগেই স্বরাষ্ট্রসচিব বলেন, “রাজ্য সরকার জিটিএ-কে সব রকম সাহায্য করেছে। পাহাড়ে উন্নয়নে গতিও এসেছে। এক বছরের মধ্যে পাহাড়ের প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। পাহাড়ের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে রাজ্য বদ্ধপরিকর।” তবে পাহাড়ের সরকারি কর্মীদের জুলাই মাসের বেতন না পাওয়ার বিষয়টিও রাজ্য সরকারকে জানাবেন বলে স্বরাষ্ট্রসচিব আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, যিনি জিটিএ-কে নস্যাৎ করে দিয়ে তার চিফ এগ্জিকিউটিভ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন, সেই গুরুঙ্গের মুখে আবার কেন উঠল ওই প্রসঙ্গ? প্রশাসনের একটি মহল বলছে, মোর্চা নেতৃত্ব দিল্লি থেকে বিশেষ সাড়া পাননি।
চিদম্বরম, জয়রাম রমেশের মতো কংগ্রেসের মন্ত্রীরা পরিষ্কার বলেছেন, আগে বন্ধ তুলুন, তার পরে কথা হবে। এমনকী, যশোবন্ত সিংহের সমর্থন ছাড়া বিজেপি-র কাছ থেকেও সে ভাবে সাড়া পাননি রোশন গিরিরা। এ দিন লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে দেখা করেন তাঁরা, বৃহস্পতিবার করবেন অরুণ জেটলির সঙ্গে। পরে রোশন গিরি দাবি করেন, গোর্খাল্যান্ডের বিষয়টি সংসদে তুলবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন আডবাণী। কিন্তু সেটা যে এই অধিবেশনে হবে না, তা-ও বুঝতে পারছেন রোশনরা। দিল্লি সূত্রের খবর, রাহুল গাঁধীর কাছ থেকে সময় পায়নি মোর্চা। যদিও গুরুঙ্গ হাল ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মোর্চার একটি সূত্র জানাচ্ছে, বৃহস্পতিবার সম্ভবত দিল্লি যাচ্ছেন গুরুঙ্গ। রোশন গিরিদের তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, শুক্রবার যাতে রাহুলের কাছ থেকে আধ ঘণ্টা সময়ও পাওয়া যায়, সে জন্য চেষ্টা চালাতে। ঘনিষ্ঠমহলে গুরুঙ্গ বলেছেন, যে করেই হোক, কিছু ক্ষণের জন্য তিনি দেখা করতে চান কংগ্রেস সহ-সভাপতির সঙ্গে। এ দিন সাংবাদিকদের গুরুঙ্গ বলেন, “আমরা রাহুল গাঁধীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। সময় চেয়েছি। উনি সময় দিলেই আমি দিল্লি রওনা হব।”
মোর্চার বনধে সুনসান রাস্তা। বুধবার সুকনায় বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
সুর কিছুটা নরম করলেও প্রশাসনের উপর থেকে চাপ কমাতে চাইছেন না মোর্চা সভাপতি। তাই এ দিন তাঁর মুখে বিস্তর অভিযোগ। জিটিএ-র আওতায় দফতর হস্তান্তরে গড়িমসি, নানা ব্যাপারে জিটিএ-কে এড়িয়ে রাজ্য সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া সবই এসেছে গুরুঙ্গের কথায়। এর পাশাপাশি দৈনন্দিন রসদের ভাঁড়ার তলানিতে ঠেকায় পাহাড়বাসীদের একাংশ যে আপাতত বন্ধ শিথিলের আর্জি জানাচ্ছেন, সেটাও কার্যত মেনেছেন গুরুঙ্গ। তাঁর কথায়, “আমরা অনির্দিষ্টকালের বন্ধ ডেকেছি। তাতে নানা অসুবিধে হওয়ারই কথা। সে জন্য স্বার্থত্যাগ করতে হবে। কিন্তু পাহাড়ের মানুষ যদি চান বন্ধ শিথিল করতে হবে, তা হলে করতে হবে। আবার যদি পাহাড়বাসীরা চান বন্ধ প্রত্যাহার করা হোক, তবে সেটাই হবে।” ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবসেও যে বন্ধ থাকবে না, সে কথাও এ দিন জানিয়েছেন তিনি।
উল্টো দিকে, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী এ দিন যা বলেছেন, তাতে সদিচ্ছার বার্তা মিলেছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট লোকজন। এ দিন স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পরে গৌতম দেব বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী প্রথম থেকেই বলছেন, পাহাড়ে জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে হবে। জিটিএ-র মাধ্যমে উন্নয়নে গতি বাড়াতে হবে।” তাঁর কথায়, “জিটিএ একটা নতুন ব্যাপার। গণতন্ত্রে সব সময়ে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।” মোর্চা সম্পর্কে তিনি বলেন, “মোর্চা নেতারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বছরখানেক আগে যোগ দিয়েছেন। ওঁদের বুঝতে সময় লাগবে। ফলে, জিটিএ চালাতে সমস্যা হতেই পারে।” এর পরে তিনি জানান, ভুলত্রুটি শুধরে এগোতে হবে। “সে জন্য আলোচনায় বসাই যেতে পারে। গণতন্ত্রে আলোচনার দরজা কখনও বন্ধ হয় না।” তবে গৌতমবাবুর সংযোজন, “পাহাড়ে জিটিএ-র মাধ্যমেই উন্নয়ন হবে, এর কোনও বিকল্প নেই।”
এই পরিস্থিতিতে এ দিন পাহাড়ে হিংসার ঘটনা ছিল কম। তবে জিটিএ-র অফিসে বৈঠকের পরে জেলাশাসকের অফিসে যাওয়ার পথে স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় মোর্চার অবরোধ-বিক্ষোভের মুখে পড়েন। শেষ পর্যন্ত গাড়ি ছেড়ে এসপি অফিসের ভিতরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে জেলাশাসকের অফিসে যেতে হয় বাসুদেববাবুকে। ওই সময়ে তাঁর সামনে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে স্লোগান দিয়ে ‘গো ব্যাক’ আওয়াজ তোলেন মোর্চার বিক্ষোভকারীরা। দু’দফায় বৈঠকের পরে বাসুদেববাবু শিলিগুড়িতে চলে যান। সেখানে তিনি একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে সরকারের তরফে তাঁরা আরও কী সাহায্য চান, তা জানতে চান।
বনধে ছাড় দেওয়া হয়েছে দুধ বিক্রিতে। বুধবার দার্জিলিঙের চকবাজারে রবিন রাইয়ের তোলা ছবি।
পাহাড়ে যাতে জনজীবন সচল এবং জরুরি পরিষেবা বহাল থাকে সে জন্য এ দিন রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। যাদের জন্য স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছে আদালত। আইনজীবী রমাপ্রসাদ সরকারের দায়ের করা ওই জনস্বার্থ-মামলার রায়ে প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, পানীয় জল, দুধ সরবরাহ, টেলিফোন ও চিকিৎসার মতো অত্যাবশ্যক পরিষেবা অবিলম্বে চালু করতে হবে। জনগণের হেনস্থা বন্ধ করতে হবে। যারা জনজীবন অচল করার কাজে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবস্থা করতে হবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার। হাসপাতাল, চিকিৎসাকেন্দ্র, ওষুধের দোকান খোলা রাখতে হবে। দার্জিলিং জেলার এসপি-কে হাইকোর্টের নির্দেশ অবিলম্বে পাঠাতে হবে। নির্দেশের প্রতিলিপি পাঠাতে হবে জনমুক্তি মোর্চাকে।
এ দিন রাজ্যের জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সরকার বন্ধের বিরুদ্ধে। কড়া হাতে বন্ধ মোকাবিলা করা হবে। পাহাড়ে ওষুধের দোকানও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে শুনে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী বলেন, “এটা অপরাধ!” ডিভিশন বেঞ্চ বলে, গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়ার বিচারে তারা যাচ্ছে না। কেবল জনজীবন স্বাভাবিক রাখার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলছে। বিচারপতিরা জানান, ইতিপূর্বে সুপ্রিম কোর্টও বন্ধের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। একই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাদের নির্দেশ যে পালিত হয়েছে, এসপি-কে তা রিপোর্ট দিয়ে জানাতে হবে। বুধবার ফের শুনানি হবে।
রাজ্যের তরফে অবশ্য বন্ধ রুখতে চাপও বজায় রাখা হয়েছে। এ দিন পাহাড়ের নানা এলাকা থেকে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার ছাত্র সংগঠনের-সহ সভাপতি অমৃত ইয়নজন-সহ ৩৭ জনকে বিভিন্ন পুরনো মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তা নিয়ে সন্ধ্যার পরে দার্জিলিং থানা ঘেরাও করেন মোর্চার কর্মী-সমর্থকেরা। পুলিশ তিন জনকে ছেড়ে দিলে ঘেরাও উঠে যায়।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.