বাস দাঁড়ানোর জন্য পৃথক লেন নেই। যেখানে বাস দাঁড়ায়, তাকে ঘিরে নেই শেডও। উপযুক্ত আলো নেই। নেই জল নিকাশি ব্যবস্থা, সুলভ শৌচালয়, পানীয় জল, বাসকর্মীদের বিশ্রামের ঘর। এমনকী কোনও যাত্রী প্রতীক্ষালয়ও নেই। অথচ এটিই মহকুমার সব থেকে বড় এবং ব্যস্ততম বাসস্ট্যান্ড। কিন্তু চালু হওয়ার ২৫ বছর পরেও প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর প্রায় অধিকাংশই গড়ে ওঠেনি রামপুহাট বাসস্ট্যান্ডে।
ফলে চড়া রোদে মাথা গোঁজার জায়গা নেই। বৃষ্টির মরসুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা ছাড়া উপায় নেই। ছুটতে হবে বাসস্ট্যান্ড চত্বরে থাকা অবৈধ দোকানগুলির শেডে। সেখানেও অবশ্য সামান্য জায়গা পাওয়া নিয়েও নানা ঝক্কি-ঝামেলা। আবার বর্ষায় আরেক সমস্যা। বাসস্ট্যান্ড তখন মোরাম ধোয়া জলে কার্যত পুকুরের চেহারা নেয়।
সেই জল আর তার সঙ্গে মিশে থাকা নোংরা আবর্জনা ডিঙিয়েই কোনও রকমে নিজেকে সামলে সামগ্রী নিয়ে বাসে চড়তে হয় যাত্রীদের। বাসস্ট্যান্ডে ওই জমা নোংরা জল পেরিয়েই তাঁদের বাস মালিক সমিতির অফিসে টিকিট কাটতে কিংবা বাসের সময়সূচি জানতেও ছুটতে হয়। এ দিকে সামান্য বৃষ্টিতেই জল থৈ থৈ বাসস্ট্যান্ডের জায়গায় জায়গায় মোরাম ও পাথর উঠে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়। তারই মধ্যে কোনও রকমে দুলতে দুলতে বাসস্ট্যান্ডে ঢোকে, বের হয় বাস। |
অথচ এই বাসস্ট্যান্ড দিয়েই রোজ ভোর সাড়ে চারটে থেকে রাত সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কলকাতা, আসানসোল, কৃষ্ণনগর, ফরাক্কা, বহরমপুর, শিলিগুড়ি-সহ রাজ্যের নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পৌঁছনোর জন্য দূরপাল্লার বাস যেমন যাতায়াত করে, তেমনই বীরভূমের তিনটি মহকুমার বিভিন্ন রুটের প্রায় শ’ দু’য়েক বাসও নির্ভর করে এই বাসস্ট্যান্ডেরই। আর মহকুমার সেই ব্যস্ততম জায়গাটিরই এমন বেহাল দশা। যার জন্য বাসিন্দারা রামপুরহাট পুরসভা ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের গড়িমসি মনোভাবকেই দায়ী করছেন। পুরসভা বাসস্ট্যান্ড সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে বলে দাবি করলেও তার বর্তমান চেহারা কিন্তু অন্য কথাই বলছে।
ওই বাসস্ট্যান্ডটি আগে ছিল রামপুরহাট রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকায়। জেলা পরিষদের উদ্যোগে ১৯৮৮ সালে বড়শাল পঞ্চায়েতের বগটুই মৌজায় ১৮ বিঘা জমির উপরে (বর্তমানে ৬০ নম্বর রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম জাতীয় সড়কের ধারে) নতুন জায়গায় বাসস্ট্যান্ড স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু প্রথম থেকেই ওই বাসস্ট্যান্ডের সঠিক পরিকাঠোমা গড়ে তোলা হয়নি। উল্টে তা না গড়ে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তৈরি হয় ইউনিয়ন অফিস। ক্রমে ইউনিয়ন অফিসগুলির শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, এমনকী বীরভূম জেলা বাসমালিক সমিতির রামপুরহাট শাখার উদ্যোগে একসময় ‘পে অ্যান্ড ইউজ টয়লেট’ তৈরিও হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, প্রশাসনের তরফে পূর্ণাঙ্গ আকারে এই বাসস্ট্যান্ডের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি কোনও দিনই।
২০০৭ সালে বাসস্ট্যান্ডটি জেলা পরিষদের থেকে রামপুরহাট পুরসভার কাছে হস্তান্তরিত হয়। তত্কালীন বামফ্রন্ট পরিচালিত পুরসভা কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে পাথর দিয়ে বাসস্ট্যান্ডের জমি শক্ত করে। যদিও রামপুরহাট সাব-ডিভিশন্যাল মোটর ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সদস্য আনার শেখের অভিযোগ, “কাগজে-কলমে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ দেখানো হলেও আদৌ তা হয়নি।” আইএনটিইউসি পরিচালিত বাসকর্মচারী সংগঠনের সহ-সম্পাদক দেবব্রত ঘোষ বলছেন, “বাসস্ট্যান্ড চত্বরে পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। মাত্র চারটি আলো জ্বলে। এমনকী বাসযাত্রীদের শৌচকর্ম সারতে মাঠেও ছুটতে হয়।” বাসস্ট্যান্ডের মুখে এতদিনেও কেন ট্র্যাফিক ব্যবস্থা নেই, সে নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বীরভূম জেলা পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের জাহাঙ্গির খান। তাঁর দাবি, “বাসস্ট্যাণ্ডের সামনে বাস ঢোকা ও বের হওয়ার মুখে ট্রাফিক পুলিশের ব্যবস্থা না থাকার জন্য হরদম ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। ট্রাফিক মোতায়েন করার জন্য পুলিশ-প্রশাসনকে বারবার বলা হলেও কিছুই হয়নি।” এমনকী বাসস্ট্যান্ড ঘেরার কাজটিও আজও সম্পূর্ণ হয়নি। ফলে বাসস্ট্যান্ড চত্বরে দিনে-রাতে অবাধে নানা রকম অসামাজিক কার্যকলাপ চলে বলে তাঁদের অভিযোগ।
যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা ভেবে ৫ লক্ষ টাকা খরচ করে শৌচালয় তৈরি করেছিল বীরভূম জেলা বাসমালিক সমিতি। তার রামপুরহাট শাখার যুগ্ম সহ-সম্পাদক মিলন সেখের ক্ষোভ, “জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসন কেউ এতদিনেও কেন একটি বাসস্ট্যান্ডের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম ব্যবস্থাগুলি গড়তে পারলেন না?” এ দিকে বাসস্ট্যান্ডের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে বলেই দাবি পুরপ্রধান অশ্বিনী তিওয়ারির। তবে একই সঙ্গে তাঁর আশ্বাস, “পরিবহণ দফতর থেকে পাওয়া ৩৫ লক্ষ এবং বিধায়ক-সাংসদের থেকে পাওয়া ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে রামপুরহাট বাসস্ট্যান্ডের সার্বিক উন্নয়নের কাজ খুব তাড়াতাড়ি শুরু করব।” তবে বাসস্ট্যান্ডে অবৈধ ভাবে বসা দোকানদাররা দোকানের আবর্জনা পাশ দিয়ে যাওয়া বড় নালায় ফেলে দিয়ে জল নিকাশিতে ব্যাঘাত করছেন বলে পুরপ্রধান অভিযোগ করছেন। সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে অবশ্য ওই দোকান মালিকদের পক্ষে রবিলাল গুপ্তার পাল্টা দাবি, “বাসস্ট্যান্ড এলাকা ঝাঁট দেওয়ার জন্য পুরসভা থেকে নিয়মিত ভাবে কোনও ঝাড়ুদার পাঠানো হয় না। জঞ্জাল ফেলার জন্য পুরসভা বাসস্ট্যান্ডে নির্দিষ্ট কোনও জায়গাও তৈরি করেনি।
এই তর্জার মাঝে পড়ে ভুগছেন যাত্রীরাই। মীর কবিরুল ইসলাম নামে এক যাত্রীর ক্ষোভ, “আসলে কেউই যাত্রীদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের কথা ভাবেন না। যার ফলে এতগুলো বছর কেটে গেলেও রামপুরহাট বাসস্ট্যান্ডের পরিকাঠামো ও যাত্রী পরিষেবা কোনটারই কোনও উন্নতি হয়নি।”
|