আমাদের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক থেকে সব কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হচ্ছে, একটি করে স্কুল সংযুক্ত করতে। এই সংযোজনার আকারটা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় স্থাপন করার থেকে পৃথক হতে হবে। যেটা বাঞ্ছনীয়, তা হচ্ছে এই স্কুলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক, একটা জৈবিক বন্ধন তৈরি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরাও তাঁদের নিজস্ব গবেষণার উঁচু স্থান থেকে নেমে এসে ছোট শিশুদের গবেষণার ফলের সঙ্গে অবহিত করিয়ে দেবেন। আমি ‘অদ্ভুত’ শব্দটি আগে এই ভেবেই ব্যবহার করলাম যে, গুরুদেব তো পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের মাধ্যমে এই জাতীয় আশ্রম-পাঠশালার কথাই ভেবেছিলেন। তাই ৭০ বছর উত্তীর্ণ হওয়ার পরে কি এখন সময় এসেছে যে, আমাদের অধ্যাপকদের দিল্লির মন্ত্রক মনে করিয়ে দেবে গুরুদেবের আদর্শ শিক্ষা-চিন্তার কথা!
এ ছাড়াও সরকারি আমলারা বলছেন, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘কমিউনিটি কলেজ’ তৈরি করার কথা। যাতে আশেপাশের গ্রাম-বাসিন্দাদের আমরা শিক্ষার আয়ত্তে আনতে পারি। আবারও অবাক লাগছে এটা মনে করে যে, ওঁরা কি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাসত্র, গ্রামীণ পুনর্নির্মাণ প্রয়াস, পল্লি চর্চা কেন্দ্র এগুলোর কথা ভুলে গেছেন, না আমরাই ভুলে গেছি? শিক্ষাভবন, বিদ্যাভবন এবং ভাষাভবনের শিক্ষক-শিক্ষিকারা যাঁরা বিশ্বমানের গবেষণা করছেন তাঁদের বাদ দিয়ে বাকিরা কি এই মহত্ শিক্ষা প্রণালীর কাজে যুক্ত হয়ে বিশ্বভারতীকে একটা মডেল বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে পারেন না। যা আমাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়েছিলেন? |
এর পরে আসি গুরুদেবের অবিশ্বাস্য এবং সময়োপযোগী বিজ্ঞান চিন্তার আলোচনায়। শিশুবয়স থেকেই বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিতি ঘটাতে হবে। এবং সেটা প্রকৃতির চমত্কারিক উপস্থিতির থেকেই। তাই পাঠশালা এবং বিদ্যালয়ের ক্লাস বাইরে, গাছতলায় হবে যাতে শিশুপাঠকেরা ছোটবেলা থেকেই ঋতু পরিবর্তন, সূর্য-চন্দ্রের আবর্তন, উদ্ভিদের প্রাণতত্ত্ব, জন্তু জানোয়ারের ব্যবহার ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। পিঁপড়ে, মৌমাছি, বোলতারা কী করে তাদের নিজেদের সমাজ বা কলোনি গড়ে তোলে। রানি মৌমাছি কী করে বাকিদের পরিচালনা করে। এগুলো সবই সমসাময়িক কীটবিদ্যার বিষয় এনটোমোলজি, কার আওতায় পড়ে। তাই আমাদের পাঠভবন এবং শিক্ষাসত্রের শিশু পড়ুয়াদের আমরা সহজেই এই উঁচুমানের বিজ্ঞান-গবেষণার সঙ্গে যুক্ত করতে পারি। কিন্তু আমরা কি সেগুলো ভাবছি, না গতানুগতিক শিক্ষা প্রণালীর দিকেই আকৃষ্ট হচ্ছি?
কবির লেখা ‘বিশ্বপরিচয়ের’ ভূমিকাতে কবি স্নেহাস্পদ বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে লিখছেন‘শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রবেশ করা আবশ্যক।’ শান্তিনিকেতন আর শ্রীনিকেতনের আকাশ তুলনামূলক মোটামুটি ভাবে দূষণমুক্ত। তাই গুরুদেব পিতৃদেবের সঙ্গে ডালহৌসি পাহাড়ে গিয়ে যে ভাবে সৌরমণ্ডল এবং নক্ষত্র মণ্ডলের প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন, আমরা তো সহজেই সেটা এখানে করতে পারি। ‘বিশ্বপরিচয়’-এ এমন মূল্যবান তথ্য রয়েছে, যা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য ভাবে সমসাময়িক। ভেবে দেখলে আপনাদের একটু কৌতুক হবে যে, যখন আমরা পাশ্চাত্য চিন্তাধারাকে শিক্ষার ব্যপারে ধার করে আনছি তখন এটা কি মনে আসছে না যে, প্রকৃতিকে বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি করার ব্যাপারে ওরা অপারগ। কারণ, বেশির ভাগ সময় এত ঠান্ডা এবং বরফজমা থাকে যে, বাইরে ক্লাস করা অসম্ভব। তাই আমাদের সৌভাগ্য যে, সারা বছরই আমরা গাছের তলায় ক্লাস করতে পারি।
বর্তমানে আমাদের পাশ্চাত্য দেশগুলোর থেকে শিখতে হচ্ছে যে, একতরফা বিজ্ঞান বা সমাজবিদ্যায় আবদ্ধ থাকলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। তাই আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রীদের আবশ্যিক প্রণালীতে সংগীত বা কলার ক্লাস করতে হয়। গুরুদেব তো এখানে তাই চেয়েছিলেন, যাতে করে বিশ্বভারতীর স্নাতকরা সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার মাধ্যমে পৃথিবীর সুস্থ, সংবেদনশীল, সম্পূর্ণ নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। কবি বলেছেন, জ্ঞানের সীমানার মধ্য দিয়ে যেন খণ্ডতা প্রকাশ না-পায়।
তাঁর কথায়, ‘কোনও দিনই খণ্ড ভাবে আমি শিক্ষা দিতে চাইনি’। এই আদর্শ যদি আমরা বুঝতাম, তা হলে কি ভবনে ভবনে ভেদাভেদ রাখতে দিতাম বা বিদ্যা এবং ভাষাভবনকে পৃথক করে দিতাম? যেখানে পৃথিবীর আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিভিন্ন বিষয়ের তফাত মুছে যাচ্ছে। যেমন, জীববিদ্যা, পদাথর্র্বিদ্যা এবং রসায়নবিদ্যা একে অন্যের পরিপূরক হয়ে যাচ্ছে, সেখানে গুরুদেবের প্রিয় প্রতিষ্ঠানে কেন আমরা শিক্ষাকে ‘খণ্ডক্ষুদ্র’ করে দেখার প্রবণতায় আকৃষ্ট হচ্ছি?
আমরা সম্প্রতি চিন দেশে গিয়েছিলাম। ওখানে যেটা দেখে খুব ভাল লাগে যে, বিকেলবেলা হতেই বাল-বৃদ্ধ নির্বিশেষে বেরিয়ে পড়ে। উদ্যানে, রাস্তার কোণে কোণে, যেখানে তাঁরা বাজনার সঙ্গে নাচে মত্ত থাকেম। এই অধ্যবসায়ের ভিতরে শরীর চর্চার সঙ্গে সঙ্গে সংগীতের যে স্নিগ্ধ প্রভাব মনের উপর বাসা বাঁধে, তারই তো প্রতিফলন দেখা যায় বৃক্ষরোপণ বা বসন্তোত্সবের নৃত্যের মধ্য দিয়ে। আবার কলাভবনের পড়ুয়ারা যখন প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে বসে ছবি আঁকেন, তখন মনটা ভরে যায় গুরুদেবের ‘সর্বশিক্ষা অভিযানের’ ব্যাপারে দূরদর্শিতার কথা ভেবে।
|
(বাইশে শ্রাবণ বিশ্বভারতীর উপাচার্যের প্রদত্ত ভাষণের সংক্ষিপ্ত অংশ।) |