প্রত্যাশিত ভাবেই কোচবিহারে গ্রাম পঞ্চায়েতের ফলাফলে ধাক্কা খেল ফরওয়ার্ড ব্লক। দক্ষিণ দিনাজপুরে একরকম মুছে গিয়েছে কংগ্রেস। মালদহে কংগ্রেসের হাতছাড়া হয়েছে ৩৭টি আসন। উত্তর দিনাজপুরেও দুর্বল হয়েছে কংগ্রেসের ঘাঁটি। জলপাইগুড়িতে চা বলয়ে কর্তৃত্ব খর্ব হয়েছে বামেদের। ডুয়ার্সে বীরপাড়া-মাদারিহাট পঞ্চায়েত সমিতিতে ৮টি আসন পেয়েছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। তবে তৃণমূল সামগ্রিক ভাবে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে ভাল ফলই করেছে।
মালদহের মোট ১৪৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে এ বার কংগ্রেস পেয়েছে ৩৯টি। বামফ্রন্টের হাতছাড়া হয়েছে ২৮টি গ্রাম পঞ্চায়েত। বামেরা পেয়েছে ৩৬টি। পাশাপাশি তৃণমূল ১টি আসন থেকে শক্তি বাড়িয়ে ১০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছে। তাৎপর্যপূর্ণ হল, ৫৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ওই ‘ত্রিশঙ্কু’ গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিতে কোন দল ক্ষমতাসীন হবে তা ভবিষ্যতই বলবে। তএই ফলেও খুশি কংগ্রেসের জেলা সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবু হাসেম খান চৌধুরী ও সিপিএমের জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্র। আবু হাসেম খান চৌধুরী বলেন, “তৃণমূল ভেবেছিল পঞ্চায়েত নির্বাচনে গনি মিথকে ভেঙে চৌচির করে দেবে। কিন্তু মালদহের মানুষ তৃণমূলকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। মাত্র ১০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেই এখন ওরা হম্বিতম্বি করছে। তৃণমূলের সন্ত্রাসের পরেও যে আমরা ৩৯ টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করতে পেরেছি এটাই অনেক।” অন্য দিকে তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী বলেন, “মালদহে আমার শক্তি ছিল শূন্য। আমরা ১০ গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছি। গনি খানের দূর্গে এতগুলি পঞ্চায়েত দখল করা মানে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে। আমরা খুশি।”
উত্তর দিনাজপুরের কংগ্রেসের ঘাঁটি এ বার ভোটে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তৃণমূল আগের তুলনায় শক্তি অনেকটাই বাড়িয়ে নিয়েছে। গত বার জেলায় তৃণমূলের ভোটের খাতায় কোনও নাম না থাকলেও এদিন ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূল একাই দখল করে নিয়েছে। তবে ভোট কাটাকাটির রাজনীতিতে বামেরা অবশ্য খুব একটা সুবিধা নিতে পারেনি। গতবারের ২৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে বেড়ে ২৯টি পেয়েছে বামফ্রন্ট। কংগ্রেস-তৃণমূল ভোট কাটাকুটির জেরে বামেরা আগের চেয়ে বেশি আসন পেয়েছে কি না, তা নিয়েই চলছে জল্পনা। ত্রিমুখী লড়াইয়ের জেরে ১৯টি পঞ্চায়েত ত্রিশঙ্কু হয়ে পড়েছে। গত বার জেলার ৯৮ গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে একক ভাবেই ৭২টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছিল কংগ্রেস। সেখানে রাত অবধি কংগ্রেসের ঝুলিতে গিয়েছে ২৫টি পঞ্চায়েত।
গত বিধানসভা ভোটের ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকল দক্ষিণ দিনাজপুরে। বামেদের থেকে মুখ ফিরিয়েই থাকল বাংলাদেশ সীমান্তের জেলাটি। ৬৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে একক ভাবে লড়ে তৃণমূল ৩৭টি দখল করেছে। সিপিএম ও আরএসপি জোটের বামফ্রন্টকে মাত্র ১৪টি আসন পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েত ত্রিশঙ্কু এবং ৩টি টাই হয়েছে। জেলার সিপিএমের দুর্গ গঙ্গারামপুর ও আরএসপি-র শক্ত ঘাঁটি বালুরঘাট ধুয়ে সাফ হয়ে গিয়েছে বলে ভাবছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা।
গত পঞ্চায়েত ভোটে জেলার ৬৫টির মধ্যে সিপিএম ২৭টি এবং আরএসপি ২০টি মোট ৪৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছিল। তৃণমূল পায় ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েত। এ বারে বেহাল অবস্থা কংগ্রেসেরও। গতবার কংগ্রেস ৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত পেয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। এ বারে গ্রাম পঞ্চায়েতে ১টি আসনও কংগ্রেসের ভাগ্যে জোটেনি। ত্রিস্তরে কংগ্রেসের অস্তিত্ব সঙ্কটে।
জেলা সিপিএম সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য তথা প্রাক্তন মন্ত্রী নারায়ণ বিশ্বাসের অভিযোগ, “সর্বত্র সন্ত্রাস ও ভয়ভীতির মধ্যে দিয়ে আমাদের লড়তে হয়েছে, ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্র বলেন, “জনভিত্তি হারিয়ে বাম নেতারা প্রথম থেকে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তাতে মানুষ সাড়া দেননি।”
গত ভোটে বালুরঘাট ব্লকের ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১০টি আরএসপির দখলে ছিল। এবারে কার্যত আরএসপি-র ঝুলি শূন্য হল কেন? আরএসপি-র জেলা সম্পাদক তথা প্রাক্তন কারামন্ত্রী বিশ্বনাথ চৌধুরীর অভিযোগ, “ভোটের আগে থেকে যে ভাবে বাইক বাহিনীর দাপট ও বিভিন্ন জায়গায় অর্থকরী লেনদেনের ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমরা পেরে উঠিনি। প্রশাসনকে জানিয়েও সাহায্য পাইনি। তবে মানুষ যে রায় দিয়েছেন, তা আমরা মেনে নিচ্ছি।” এ বার পঞ্চায়েত ভোটে কোচবিহারে ধাক্কা খেল ফরওয়ার্ড ব্লক। কংগ্রেস ও বিজেপিরও অবস্থা তথৈবচ। সে তুলনায় সাফল্য পেয়েছে তৃণমূল। জেলায় ১২৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে তৃণমূল একক ভাবে পেয়েছে ৮০ টি। গত পঞ্চায়েতে তাদের দখলে ছিল ২৭ টি গ্রাম পঞ্চায়েত। অন্য দিকে বামেদের পঞ্চায়েত সংখ্যা ৮৪ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২২টি। কংগ্রেস পেয়েছে ৩ টি। ত্রিশঙ্কু অবস্থায় আছে ২০টি পঞ্চায়েত। তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতে আসন টাই হয়েছে। ওই বাম শরিক দলের খাস তালুক বলে পরিচিত দিনহাটা মহকুমার দিনহাটা ২ ও সিতাই পঞ্চায়েত সমিতি ফরওয়ার্ড ব্লকের হাতছাড়া হয়েছে। সিপিএমের দখলে থাকা দিনহাটা ১ পঞ্চায়েত সমিতিও গিয়েছে তৃণমূলের দখলে। ওই মহকুমার তিনটি ব্লকের ৩৩ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে গত নির্বাচনে ফরওয়ার্ড ব্লক ২০টি সিপিএম ৯ টিতে প্রধান পদ দখল করেছিল। এবার সিতাই ব্লকে কোনও গ্রাম পঞ্চায়েত বামেরা জিততে পারেনি। ৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতই গিয়েছে তৃণমূলের দখলে। দিনহাটা ১ ও দিনহাটা ২ নম্বর ব্লকের ১২ টি ও ১৬ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে তৃণমুল জিতেছে ১৪ টি। বামেরা পেয়েছে ২ টি। কংগ্রেস ১ টি। ১১ টি ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে।
কংগ্রেস গতবার ৮ টি গ্রাম পঞ্চায়েতে জিতলেও এবার পেয়েছে ৩টি। বিজেপি তাদের ৪ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের একটিও দখলে রাখতে পারেনি। তৃণমূলের জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “উন্নয়নের পাশে থাকাই শুধু নয়, মানুষ বামেদের খুনের রাজনীতির বিরুদ্ধেও রায় দিয়েছেন। ভোটের আগে এবার আমাদের ৪ কর্মী খুন হন।”
বামেরা অবশ্য পাল্টা অভিযোগ, “খুনের মিথ্যা মামলায় বাম নেতা-কর্মীদের মামলায় জড়িয়ে প্রচারে বাধা দেওয়া হয়। বাইক বাহিনী নিয়ে জেলা জুড়ে সন্ত্রাস হয়। সন্ত্রাসের আবহে ভোট হওয়ায় প্রকৃত জনমত উঠে আসেনি।” ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহের অভিযোগও সন্ত্রাস নিয়েই। তাঁর অভিযোগ, শাসক দলের সন্ত্
জলপাইগুড়িতে পঞ্চায়েত নির্বাচনে চা বলয়ের বেশির ভাগ গ্রাম পঞ্চায়েত হাতছাড়া হল বামেদের। মেটেলি ব্লকের মাত্র ২টি, নাগরাকাটার একটি গ্রাম পঞ্চায়েত বামেরা দখল করতে পেরেছে। মাদারিহাট বীরপাড়া ব্লকের গ্রাম পঞ্চায়েত হাতছাড়া হয়েছে বামেদের। চা বলয়ের মতোই ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি এবং ফালাকাটার মতো বাম অধ্যুষিত ব্লকের কর্তৃত্ব গিয়েছে তৃণমূলের হাতে। ময়নাগুড়ি, বীরপাড়া, ফালাকাটা পঞ্চায়েত সমিতির নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়েছে তৃণমূল। জেলার সব প্রান্তেই পঞ্চায়েতে সাফল্য পেলেও জলপাইগুড়ি সদর ব্লকে মাত্র একটি পঞ্চায়েত নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তৃণমূলকে। |