ঘাসফুলে দক্ষিণবঙ্গ, উত্তরে জোর টক্কর
জেলা পরিষদের ছবি পুরোপুরি পরিষ্কার হতে মঙ্গলবার হয়ে যাবে। কিন্তু সোমবার সন্ধ্যায় মহাকরণ ছাড়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে গেলেন, ১৭টি জেলার মধ্যে ১৩টিতেই জিতবে তৃণমূল। আরও দু’টি জেলাতেও পরিষদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে তাঁর দল। অর্থাত্‌, প্রায় ৯০ শতাংশ জেলাই থাকবে তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণে।
দু’বছর আগের বিধানসভা ভোটেই দক্ষিণবঙ্গে বামেদের কার্যত ধুয়েমুছে দিয়েছিল তৃণমূল। সোমবার রাত পর্যন্ত গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতির ভোট গণনা সেই প্রবণতা বজায় রাখারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। শাসক দলের পক্ষে বাড়তি উল্লাসের কারণ এটা যে, মধ্যবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গে তাদের প্রভাব বাড়ার ইঙ্গিত মিলছে।
ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই জেলা পরিষদের ফল। কারণ, এই ফলই বলে দেবে কোন জেলা কার দখলে গেল। গোটা রাজ্যের নিরিখে রাজনৈতিক দলগুলির জনপ্রিয়তার সামগ্রিক মূল্যায়ন জেলা পরিষদের ফল বেরনোর পরেই করা সম্ভব। যদিও অনেক রাজনৈতিক নেতার মতে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির ফলও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ এর থেকেই তৃণমূল স্তরে আমজনতার মনোভাবের আঁচ মেলে। আর সেই নিরিখে ২৬ মাসের শাসনপর্বে পার্ক স্ট্রিট থেকে কামদুনি, নানা বিতর্কের মুখোমুখি হয়েও গ্রামবাংলায় মমতা-ম্যাজিক অটুট।
সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত আটটি জেলা পরিষদের ফল বেরিয়েছে। তার মধ্যে কোচবিহার, বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর এবং পশ্চিম মেদিনীপুর সাতটিই দখল করেছে তৃণমূল। জলপাইগুড়ি জিতেছে বামেরা। গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির হিসেবে হুগলি, হাওড়া, বর্ধমান, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় তৃণমূলের রমরমা। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ছাড়া জঙ্গলমহলের আর একটি জেলা পুরুলিয়ায় দুই স্তরেই তারা নিরঙ্কুশ।
২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের থেকেও এ বার তৃণমূলের ভোট বেড়েছে দাবি করে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “এখনও পর্যন্ত যা হিসেব করেছি, তাতে ৭৪-৭৫% ভোট আমরাই পেয়েছি। জঙ্গলমহলে ২৯০টির মধ্যে ২৭৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত জিতেছি।” গোঘাট, রায়পুর, সারেঙ্গা, গড়বেতার মতো সিপিএমের শক্ত ঘাঁটিতেও এ বার তৃণমূলের রমরমা।
তবে দক্ষিণবঙ্গে শাসক দলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হয়েছে নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনায়। দুই জেলাতেই বামেরা যেমন গ্রাম পঞ্চায়েত দখলের নিরিখে তৃণমূলের কাছাকাছি শেষ করেছে, তেমনই বেশ বড় সংখ্যক পঞ্চায়েত ত্রিশঙ্কু হয়েছে। পাঁচ বছর আগে জেলা পরিষদ অল্পের জন্য দখল করতে না-পারলেও তৃণমূল উত্তর ২৪ পরগনায় যতগুলি গ্রাম পঞ্চায়েত জিতেছিল, এ বার সেই সংখ্যা কমেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছু অংশে ফল ভাল হয়েছে বামেদের। নদিয়ায় পঞ্চায়েত সমিতির দৌড়ে তৃণমূলকে পিছনে ফেলে দিয়েছে বামেরা। ১৫টি সমিতির মধ্যে তারা ৮টি দখল করেছে।
দক্ষিণবঙ্গে এই বিক্ষিপ্ত ধাক্কা উত্তরবঙ্গে সুদে আসলে পুষিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। গত বিধানসভা ভোটেও উত্তরের জেলাগুলিতে তাদের কতটা জোর ছিল, সেটা তর্কসাপেক্ষ। কারণ, জোটসঙ্গী কংগ্রেসের দাবি ছিল, সেখানে তাদের দাপটেরই প্রতিফলন হয়েছে বিধানসভার ভোটবাক্সে। কিন্তু জোট ভাঙার পরে একা লড়ে কোচবিহার ইতিমধ্যেই জিতে নিয়েছে তৃণমূল। দক্ষিণ দিনাজপুরেও গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির নিরিখে এগিয়ে তারা। বামেদের শক্ত ঘাঁটি জলপাইগুড়িতেও এই দুই স্তরে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। অন্য দিকে, শক্তি খুইয়ে আবু হাসেম (ডালু) খান চৌধুরীর মালদহ হারানোর মুখে কংগ্রেস। দীপা দাশমুন্সির উত্তর দিনাজপুরে জেলা পরিষদ ত্রিশঙ্কু হবে এবং তৃণমূল সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে বলে মনে করছেন মমতা। তিনি বলেন, “অনেক জায়গাতেই আমরা এ বার প্রথম একা লড়েছি। এর আগে ওই জায়গাগুলি আমরা জোট দলকে ছেড়ে দিতাম। সেই হিসেবে ফল ভালই হয়েছে। আগামী দিনে আরও ভাল হবে।”
কংগ্রেসের হয়ে খানিকটা হলেও দুর্গরক্ষার কাজটা করেছেন একমাত্র অধীর চৌধুরী। তাঁর ক্যারিশমার জোরে গত পঞ্চায়েত ভোটে ক্ষমতা হারানো মুর্শিদাবাদে বামেদের সঙ্গে সমানে সমানে লড়ছে কংগ্রেস। সামগ্রিক ভাবে অতএব এখনও পর্যন্ত ফলাফলের যা প্রবণতা, তাতে সব মিলিয়ে স্বস্তিতেই শাসক দলের নেতারা। কারণ, পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় পাঁচ বছর জেলা পরিষদ চালিয়েও প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়া অনেকটাই রোখা গিয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরে পঞ্চায়েত সমিতির ২৫টি আসনের মধ্যে ২৪টিই জিতে নিয়েছে তৃণমূল। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ঘোষিত ২১টির মধ্যে ১৫টি। তা ছাড়া, মমতার জমি আন্দোলনের দুই স্মারক নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর রয়ে গিয়েছে তৃণমূলের পক্ষেই। নন্দীগ্রামে নির্দল তথা বিক্ষুব্ধদের নিয়ে কিছু অস্বস্তির কাঁটা সত্ত্বেও। সারদা-কাণ্ডের বিশেষ কোনও প্রভাব এখনও চোখে পড়েনি। পার্ক স্ট্রিট থেকে কামদুনি, কোনও কাণ্ডই সার্বিক ভাবে গ্রাম পঞ্চায়েতে বড় কোনও প্রভাব ফেলেনি। পাশাপাশি দক্ষিণবঙ্গে গোঘাট, রায়পুর, সারেঙ্গা, গড়বেতা, কেশপুরের মতো সিপিএমের শক্ত ঘাঁটিতে অন্তত গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে তৃণমূলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হওয়ায় শাসক দলের নেতারা আনন্দিত। পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বর্ধমানের মতো অতীতের বাম দুর্গকে প্রায় দুরমুশ করে দিতে পেরেছেন তাঁরা। দৃশ্যতই তৃপ্ত মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেছেন, “বাংলায় এই প্রথম গণতন্ত্রের উত্‌সব হয়েছে। তার জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মানুষের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। এই জয় আমি মানুষকেই উত্‌সর্গ করলাম।” বিরোধীরা অবশ্য মনে করছে, পঞ্চায়েতের এই ফল পুরোপুরি গ্রামবাংলার মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার ছবি নয়। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর অভিযোগ, “তৃণমূল তাদের মাস্টার-প্ল্যান অনুযায়ী নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার চেষ্টা করেছে! সন্ত্রাস যেখানে, তৃণমূল জয়ী সেখানে!” ভোট গণনাতেও কারচুপির অভিযোগ এনে তিনি বলেন, “বারবার চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও গণনা সফল করতে নির্বাচন কমিশনের যা প্রয়োজন ছিল, তা তারা করেনি।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও তৃণমূলের জবরদস্তির দিকে আঙুল তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, “যা অনিবার্য ছিল, তা-ই হয়েছে! এ বার লড়াই হয়েছে সন্ত্রাস বনাম গণতন্ত্রের। আমরা সেই লড়াইয়ে পরাজিত হয়েছি। কারণ, এক দিকে আমাদের আর্থিক সঙ্কট, অন্য দিকে সাংগঠনিক দুর্বলতা।”
বিরোধীদের তোলা সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “ও সব বলে লাভ আছে। এক জনও কেউ নেই যিনি বলেছেন, ভোট দিতে পারেননি। এ বারেই সব থেকে বেশি মনোনয়ন দাখিল হয়েছে। এত কম বুথে পুর্ননির্বাচন আগে কখনও হয়নি।” উল্টে নাম না-করে অধীর চৌধুরীর প্রতি তাঁর কটাক্ষ, “মুর্শিদাবাদে তাণ্ডব, দাপাদাপি বেশি হয়েছে। তা কে করেছে সকলেই জানেন।” পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকেও কটাক্ষ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কেন্দ্র থেকে শুরু করে সাংবিধানিক শক্তি আমাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করেছে। বিদেশেও সরকারের বিরুদ্ধে কুত্‌সা করতে ছাড়েনি। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট হয়েছে, মহকুমা শাসকের অফিসে মনোনয়ন জমা দেওয়া গিয়েছে। যা আগে কখনও হয়নি। ১৪৪ ধারা জারি করে, কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে গণনা হয়েছে। মানুষ এত মিথ্যা বরদাস্ত করে না।” আর তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “বহু অপপ্রচার, কুত্‌সা সত্ত্বেও তৃণমূলের প্রতি মানুষের আস্থা কমেনি। সিপিএম এ রাজ্যে অবলুপ্তির পথে! জেলা পরিষদ থেকে নামতে নামতে গ্রাম পঞ্চায়েতে এসে ঠেকেছে! এর পর তো স্কুল নির্বাচনে আটকে থাকবে!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.